ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ভাঙ্গায় আসন পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে

দুই ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করায়  থানা ও উপজেলা পরিষদে হামলা

ফরিদপুর ও ভাঙ্গা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ১০:৪৯ পিএম

ফরিদপুরে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে ও পুরোনো সীমানা বহালের দাবিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে একযোগে ভাঙ্গা থানায় ও উপজেলা পরিষদে হামলার ঘটনা ঘটেছে। মুহূর্তেই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে পড়ে। গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে অবরোধকারীরা প্রথমে ভাঙ্গা থানায় হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় থানার পুলিশ সদস্যরা ভেতরে আটকা পড়েন। হামলাকারীরা থানায় উদ্ধার করে রাখা একটি অ্যাম্বুলেন্সে অগ্নিসংযোগ করে। প্রায় আধঘণ্টা তা-ব চালিয়ে হামলাকারীরা চলে যায়। একই সাথে ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়, ইউএনও’র কার্যালয়সহ উপজেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, নির্বাচন অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফরিদপুর-৪ আসনের পুনর্বিন্যাস বাতিলের দাবিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকে গত রোববার থেকে তিন দিনের সকাল-সন্ধ্যা মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। গতকাল সকাল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে উপজেলা পরিষদ এলাকায়। গ্রামে মাইকিং করে লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্রসহ অবরোধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বেলা ১১টার দিকে ভাঙ্গার আলগী এলাকায় আন্দোলনকারীরা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দুপুর ১২টার দিকে অবরোধকারীরা থানার সামনে অবস্থান নিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা প্রতিহত করে। এরপর গ্রামে ঢাল, সড়কি নিয়ে অবরোধে অংশ নেওয়ার জন্য পুনরায় মাইকিং করা হয়। সকাল ৯টার দিকে মহাসড়কের দু-একটি স্থানে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করলেও যান চলাচলে তেমন বাধা ছিল না। তবে দুপুরের আগেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।

আলগী, হামিরদী ইউনিয়নসহ ভাঙ্গার অন্যান্য ইউনিয়ন থেকেও বিপুলসংখ্যক মানুষ রোড ব্লকেডে অংশ নেয়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়।

এর আগে রেলপথ ও মহাসড়ক অবরোধকে কেন্দ্র করে ভাঙ্গা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। থানার এসআই হাবিবুর রহমান ৯০ জনের নাম উল্লেখসহ দেড় শতাধিক অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, সুয়াদি এলাকায় রাস্তার ওপর গাছ ফেলে, টায়ারে অগ্নিসংযোগ করে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এদিকে গতকাল তথ্য সংগ্রহকালে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। 

বিক্ষুব্ধ জনতা ভাঙ্গা থানা ও উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করার পর উপজেলা অফিসার্স ক্লাবে অগ্নিসংযোগও করে। এ সময় সাংবাদিকদের ওপরও চড়াও হন বিক্ষোভকারীরা। তাদের মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করা হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের আলগী ইউনিয়নের সোয়াদী এলাকা থেকে শুরু হওয়া ‘লং মার্চ টু ভাঙ্গা’ দুপুর ১২টার মধ্যে গোলচত্বর এলাকায় এসে পৌঁছায়। পূর্বঘোষিত অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েসহ একাধিক সড়ক-মহাসড়কে নেমে আসে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীকে রাস্তায় নামতে বলা হয়। এতে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং অসংখ্য গাড়ি আটকে পড়ে। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা সড়কের ওপর বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে এবং টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। বিক্ষুব্ধ জনতার ইটপাটকেলে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। একপর্যায়ে ১০-১২ জন আর্মড পুলিশ সদস্যকে ধাওয়া করে ভাঙ্গা কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মসজিদের ভেতরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। সেখানে মাদ্রাসা ও মসজিদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের ঘিরে রেখে রক্ষা করেন।

এরপর উত্তেজিত জনতা থানার দিকে এগিয়ে গিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা থানার গাড়ি ও থানা ভবনে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এ সময় ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এরপর আন্দোলনকারীরা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে গিয়েও ভাঙচুর চালায় এবং সেখানে থাকা একাধিক গাড়ি ও মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই সাথে হাইওয়ে অফিস ও পৌরসভা কার্যালয়েও ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়।

এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘আমরা যখন ভাঙচুরের ঘটনাগুলো ধারণ করছিলাম, তখন বিক্ষোভকারীরা আমাদের দিকে তেড়ে আসে। তারা ক্যামেরা ও মুঠোফোন কেড়ে নেয় এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। পরে আমরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করি। এখন সবাই আত্মগোপনে আছি।’

এ বিষয়ে ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার  ওসি মো. রোকিবুজ্জামান বলেন, ‘যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন।’

ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদীয় সীমানা পুনর্বিন্যাসের গেজেট প্রকাশের পর থেকেই স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। গত ৪ আগস্ট নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত এই গেজেটে ভাঙ্গার আলগী ও হামিরদি ইউনিয়নকে পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর-২ আসনে যুক্ত করা হয়। এরপর থেকে দফায় দফায় অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি চলছে। যার ফলে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে।

জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল হাসান মোল্যা জানান, তারা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, আসন পুনর্বিন্যাসের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে এবং দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তিনি আশা করেন, দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে। পরিস্থিতি বর্তমানে থমথমে থাকলেও যেকোনো মুহূর্তে আরও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদের আসন পুনর্বিন্যাসসংক্রান্ত গেজেটে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে ভাঙ্গার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নকে ফরিদপুর-২ আসনের সাথে যুক্ত করা হয়। এর প্রতিবাদে গেজেট প্রকাশের পর থেকেই পাঁচ দিন ধরে মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয়রা। এতে ঢাকা-খুলনা ও ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কমপক্ষে ২৩ জেলার যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।