ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

এনসিপি-গণঅধিকার একীভূত  হতে বাধা নেতৃত্বের বিরোধ

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫, ১১:৩৫ পিএম

দেশের রাজনীতিতে বিগত ১৬ বছর ধরে চলে আসা সংকট, বৈষম্য, বিচারহীনতা, জবাবদিহির অভাব এবং জনরোষ থেকে সংঘটিত হয় ’২৪-এর  জুলাই গণঅভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান-পরবর্তী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গড়ে ওঠে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি নিয়ে শুরু থেকেই গণমানুষের প্রত্যাশা ছিল সীমাহীন। দিন যত গড়িয়েছে প্রত্যাশার পারদ ততই নেমেছে।

দলটির অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা, নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগসহ সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফল এনসিপির ইমেজ সংকট প্রকাশ্যে এসেছে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এনসিপি শক্ত অবস্থান তৈরিতে একীভূত হতে যাচ্ছে গণঅধিকারের সঙ্গে। তবে এর কাঠামো কেমন হবে, কে হবেন নতুন দলের প্রধানÑএটাই এখন বড় প্রশ্ন। এনসিপি, গণঅধিকার না তৃতীয় কোনো নামে প্রকাশ পাবে দলটি, তা নিয়েই শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা। এনসিপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দেওয়া তথ্য মতে, দলের প্রধানসহ কোন প্রক্রিয়ায় হবে দলটি, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যতটা প্রত্যাশা নিয়ে এনসিপি গঠিত হয়েছিল, ততটাই হতাশা উপহার দিয়েছে তরুণদের গড়া রাজনৈতিক দলটি। 

নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে দলটি। একের পর এক বিতর্কিত কর্মকা-ে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠতে থাকে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ রাজধানীর উত্তরায় সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার মধ্যে ছিলেন এ এইচ এম নোমান রেজা, তানজিল হোসেন ও ভাইরাল ফারিয়া আক্তার তমা নামের তরুণী। এ ঘটনার আগে গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় হয়। আত্মপ্রকাশের পরপরই এনসিপি বিতর্কিত হয় যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের কর্মকা-ে।

তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগ ও এনসিটিবির বই ছাপার কাজে ‘কমিশন বাণিজ্য’ ও ‘হস্তক্ষেপ’ করার বড় অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনায় দলের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে বেশ মতবিরোধ। 

চলমান আলোচনা-সমালোচনা পাশ কাটিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বৃহৎ শক্তি হিসেবে এনসিপির অবস্থান নিশ্চিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তরুণ নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মাঠে নামতে চায় এনসিপি। নির্বাচন ঘিরে এনসিপি অবস্থানের বিষয়ে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য আবদুল হান্নান মাসউদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন পর্যন্ত এনসিপি কোনো ধরনের জোটে যাওয়ার বিষয়ে ভাবছে না। কোনো ধরনের জোটে আমরা যাব না। তবে নির্বাচনি সমঝোতা হতে পারে বা নির্বাচনকালীন সমঝোতা হতে পারেÑ এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। শেষ মুহূর্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তিনি বলেন, আমরা এখন আরও কিছু তরুণদের দল নিয়ে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছি। যেখানে সবাই আমাদের সঙ্গে একীভূত হবে ইনশাআল্লাহ। যার মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম আরও গতি পাবে এবং আমরা আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব।

বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে গঠিত দুইটি দল গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি একীভূত হওয়ার বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব সালেহ উদ্দিন সিফাত রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা বা জোট প্রশ্নে দুই দলের ভেতর অনানুষ্ঠানিক কিছু বৈঠক হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা এখনো হয়নি। যেহেতু বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত রয়েছে, একই সাথে এনসিপির নিবন্ধেনের বিষয়ে কাজ প্রক্রিয়াধীন। অপরদিকে গণঅধিকার পরিষদ ইতিমধ্যে একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। সুতরাং যে আলোচনা চলমান রয়েছে, তার ফলাফল কী হবে তার জন্য দুই দলের পক্ষ থেকে আরও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা মনে করি, দেশের রাজনীতিতে বিএনপি এবং জামায়াত বড় দুইটি রাজনৈতিক শক্তি বা মেরুকরণ রয়েছে। তার বাইরে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তরুণদের নতুন একটি শক্তির প্রকাশ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এনসিপি তার রাজনৈতিক আদর্শ, কালচার ইতিমধ্যে মানুষের মাঝে প্রকাশ করেছে। তিনি আরও বলেন, এনসিপি যে রাজনৈতিক আদর্শ দেখিয়েছে, সেই আদর্শের সঙ্গে একমত পোষণ করে, জাতীয় নির্বাচন ও সংস্কার এজেন্ডাকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যদি ঐক্যবদ্ধ হতে চায় বা আসতে চায়; আমরা তাদের স্বাগত জানাই।

এনসিপির জনপ্রিয়তার প্রশ্নে তিনি বলেন, জনগণের পক্ষে জনস্বার্থে ৫ আগস্টের আগে আমরা যেভাবে ছিলাম, এখনো একইভাবে কাজ করছি। জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে ডাকসু, জাকসু নির্বাচনের ফলাফলের ওপর আসলে এনসিপির জনপ্রিয়তা নির্ভর করে না। কারণ যারা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, সবাই অভ্যুত্থানের পক্ষের লোক।

এনসিপি থেকে বের হয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দলে অনেকে আসতে পারে আবার বেরও হতে পারে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলগুলো মতাদর্শ পছন্দ হলে অন্য দল থেকেও নতুন দলে আসতে পারে। যেমনিভাবে এনসিপির সঙ্গে ছাত্রদল, শিবির এবং ইউনিয়ন থেকে অনেক ছাত্রনেতা যোগ দিয়েছেন। একই সাথে কেউ যদি মনে করেন, দল থেকে পদত্যাগ করবেন, সেই স্বাধীনতা অবশ্যই আছে। এটা নিয়ে আমাদের আলাদা কোনো বক্তব্য নেই। তবে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে কেউ বের হয়ে নতুন কোনো দল গঠন করছে কি না, সেই বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই বা পাইনি। কেউ যদি বের হয়ে নুতন দল গঠন করতে চায়, সেই স্বাধীনতাও সবার রয়েছে।  

এনসিপির জনপ্রিয়তা কমার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সংগঠক ও জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক শ্যামলী সুলতানা জেদনী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জনপ্রিয়তা কমার ক্ষেত্রে অনৈক্য বড় কারণ বলে আমি মনে করি। গণঅভ্যুত্থানের পর যখন নতুন সংগঠন হয়েছে, তখন সেই সংগঠনকে ধারণ করে সবার একসঙ্গে কাজ করা উচিত ছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর এনসিপিকে সবাই খুবই ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরবতী সময়ে দলের কিছু নেতাকর্মীর অপকর্মের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। তবে বর্তমান এনসিপি জেলা-উপজেলা থেকে সব পর্যায়ে যেভাবে তারা আলোচনা শুরু করেছে, তাতে তারা সেই আগের গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবে বলে আশা করি। 

তিনি আরও বলেন, এনসিপির বড় একটি ভুল তারা শুরুতেই সবাইকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছে। যদি স্পষ্ট করতে হয় তবে বলতে হয়, দেশের প্রতিটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে শত্রু বানিয়েছে।  অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের মানুষ তাদের থেকে অনেক কিছু আশা করেছিল। তাদের উচিত ছিল সে আশার মূল্যায়ন করা। একই সাথে অভ্যুত্থানের তরুণ শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক দল গঠনের ক্ষেত্রে উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার স্থান আরো পরিষ্কার করে দল গঠন করা। সবার সঙ্গে পরমর্শ করা। তবে তারা সেই স্থান না বেছে নিয়ে দায় দিয়েছেন অন্য দলগুলোর ওপর। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও তাদের জনপ্রিয়তা কমেছে, যা না-ও কমতে পারত।  

এনসিপি ও গণঅধিকারের ঐক্য হলে সেটা নুরুল হক নুরের নেতৃত্বেই হওয়া উচিত বলে মনে করেন গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ফ্যাসিবাদের উত্তাল সময়ে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে গড়ে ওঠা দল গণঅধিকার পরিষদ। ’১৮-এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নেতৃত্বে ২০২১ সালে দলটি গঠিত হয়। দল গঠনের পূর্বে এই তরুণদের নেতৃত্বে ছাত্র, যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদ দেশের মানুষের পক্ষে রাজপথে কথা বলেছে, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। পরবর্তী সময় এই তরুণদের বড় একটি অংশ ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানেও নেতৃত্ব দিয়েছে। আবার ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সামনের সারির অনেকের রাজনীতির হাতেখড়ি এই গণঅধিকার পরিষদে। 

তিনি বলেন, এনসিপির অধিকাংশ নেতা গণঅধিকার পরিষদের সাবেক নেতা এবং তারা গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের শিষ্য। ফলে ঐক্য হলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও সামগ্রিক বিবেচনায় নুরুল হক নুরের নেতৃত্বেই হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার কারণে আমরা মনে করি, তরুণদের দুই দল একত্রিত হলে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির দ্বার উন্মোচিত হবে। তাই দু’দলের ঐক্যের বিষয়ে আমরা আন্তরিক। তার মানে এই নয়, নিজেদের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে আরেক দলে যোগ দেব।

তবে দুই দলের ঐক্য হলে তার কাঠামো কেমন হবে। তৃতীয় কোনো দল হবে কি না। সেই দলের সভাপতি, সেক্রেটারি কে বা কোন দল থেকে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে চাপা উত্তেজনা চলছে দুই দলের মধ্যেও। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিপির এক নেতা বলেন, জুলাই নেতৃত্বসহ অভ্যুত্থানের ভূমিকা এবং দলের যে গ্রহণযোগ্যতা, সেই স্থান থেকে অন্য কোনো দলের নেতৃত্বে রাজনীতি করার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। এমন কিছু হলে দল থেকে অনেকে পদত্যাগ করবে। আগে নেতৃত্ব এবং ফরমেটের বিষয়ে নিশ্চিত করেই জোটবদ্ধ হতে হবে। অথবা এনসিপি থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে।