সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা আগামীকাল রোববার থেকে শুরু হচ্ছে। দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে পালন করতে প্রশাসনের নানা পদক্ষেপ রয়েছে। তবে সেই তুলনায় প্রশাসনের কাজ দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে পূজা উদযাপন কমিটি। উৎসব শুরুর আগেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনার বিষয়ে সংগঠনটির নেতাদের ভাষ্য, দুর্বৃত্তরা হামলা করতেই পারে। ঘটনার পর দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ছে কি না, বিচার হচ্ছে কি না সেটিই তাদের ‘বিবেচ্য বিষয়’।
গতকাল শুক্রবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ’ ও ‘মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি’ আয়োজিত এক যৌথ মতবিনিময় সভায় সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয়। এ সময় নেতারা দুর্গাপূজা নির্বিঘেœ উদযাপিত হওয়ার আশা প্রকাশ করে পূজার দিনগুলোতে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং ঢাকায় অন্তত রাত ১১টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু রাখার দাবি জানান।
এদিকে র্যাব এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজধানীতে ৯৪টি টহলসহ সারা দেশে ২৮১টি টহলদল মোতায়েন করেছে র্যাব।
গতকালের মতবিনিময় সভার আগেই দেশের ১৩ জেলায় প্রতিমা ভাঙচুর ও মন্দিরে হামলার তথ্য দেওয়া হয়। জেলাগুলো হচ্ছেÑ কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, নাটোর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। প্রতিমা প্রস্তুত করার সময় মন্দিরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা দেড় দশক ধরে চলছে বলেও জানান বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর।
তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা কিছু ছড়িয়ে দিয়ে, ধর্মবিদ্বেষের ভুয়া ও মিথ্যা বার্তা দিয়ে যে হামলা করা হয়, সেটা ২০০৯-১০ সাল থেকে শুরু হয়েছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’ জানায়, দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন জেলার সাত শতাধিক ম-পকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে দুর্গাপূজা সামনে রেখে দেশের ২৯ জেলাকে ‘ঝুঁকিপ্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নাগরিক সমাজের নবগঠিত প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’।
ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে তুলে ধরার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, তারা আমাদের বলেছেন, কঠোর অবস্থানে থাকবে, আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু এলাকায় প্রতিমা এবং মন্দিরে হামলার ঘটনার পর অনেক দুর্বৃত্ত ধরা পড়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে যাচ্ছে, প্রশাসনের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমরা এটাই চেয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখেছি গত ৫৩ বছর। আমরা চাই না এই সংস্কৃতি অব্যাহত থাকুক। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব বিষয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছাড়াও ধর্ম উপদেষ্টা, আইজিপি, মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা নিয়ে কোনো উৎকণ্ঠা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন জেলায় এবং ঢাকায় যে সমস্ত স্থানে বিসর্জন দেওয়া হয়, বিশেষ করে প্রধান বিসর্জনস্থল হচ্ছে আমাদের বুড়িগঙ্গা। সেখানে অত্যন্ত সুন্দর ব্যবস্থা গতবারও ছিল, এবারও সরকারের তরফ থেকে এটা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থা এটাতে সহযোগিতা করছে। কাজেই উৎকণ্ঠা আপনারা যেভাবে বলছেন, সে অর্থে উৎকণ্ঠা নেই। আমরা পূজার আয়োজন করছি, আমরা জানি সবাই আমাদের পাশে রয়েছে।
গত এক বছর ধরে ঢালাও মামলার মাধ্যমে সংখ্যালঘু নেতাদের অনেককে হয়রানি করা হচ্ছে দাবি করে বাসুদেব ধর বলেন, এটা আমরা সরকারকে জানিয়েছি এবং সেনাবাহিনীকেও জানিয়েছি। বিভিন্ন জেলায় কিছু কিছু ঘটনা সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নিরসন হয়েছে। আমরা চাই, যেগুলো হয়নি সেগুলো সরকার এবং প্রশাসনের যেই অংশটি এটা দেখে, তারা যেন পূজার আগে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘নিñিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী’ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন আবার অতিরিক্ত কিছু করে না ফেলে। তারা অবশ্যই আমাদের দেখভাল করবে, কিন্তু অতিরিক্ত কিছু করতে গিয়ে আবার সাধারণ জনগণের মধ্যে, যারা বিভিন্ন ম-পে যাতায়াত করেন পরিবার নিয়ে, তাদের মধ্যে যেন একটা ভয়ভীতির সৃষ্টি না হয়। সেই ব্যাপারে একটু লক্ষ্য রাখতে হবে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের নির্ধারিত এলাকার সব পূজাম-পে নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে ও বৈঠক হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সুব্রত চৌধুরী আরও বলেন, সনাতনীদের আর পঞ্জিকা দেখতে হয় না, কবে জন্মাষ্টমী উৎসব আর কবে দুর্গাপূজা। চারিদিকে যখন প্রতিমা ভাংচুর শুরু হয়ে যায়, তখনই আমরা বলতে পারি সামনে একটা কোন উৎসব আসছে। এইবার এখন পর্যন্ত ১৩টি ঘটনা ঘটেছে। একদিকে আমরা সবাইকে বলছি, আনন্দ উৎসবের সাথে আপনারা অংশগ্রহণ করেন। আবার পূজাম-পে হামলার পরে অনেকেই কৃমিল্লার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, উন্মাদ ও নেশাখোর। এসবের মধ্য দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। আমরা আশা করব, প্রশাসন থেকে যেন এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া না হয়। অপরাধী যে-ই হোক, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসেন এবং একটা বিচারের ব্যবস্থা করেন।
এর আগে লিখিত বক্তব্যে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব আজ শনিবার বোধনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু এবং বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমী ও শোভাযাত্রা পালনের পর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে উৎসব শেষের কথা জানান।
প্রসঙ্গত, এবার ঢাকায় গতবারের তুলনায় ৭টি বেড়ে মোট ২৫৯টি ম-পে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর সারা দেশে মোট ম-পের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৩৫৫টি, যা গতবারের তুলনায় হাজারখানেক বেশি।
এদিকে র্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পূজাকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র্যাব দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারি এবং টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে ব্যাটালিয়নসমূহের নিজ নিজ দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় পর্যাপ্তসংখ্যক র্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবে। রাজধানীতে র্যাবের ৯৪টি টহলসহ সারা দেশে ২৮১টি টহলদল মোতায়েন রয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাটালিয়নসমূহ নিজ নিজ কন্ট্রোলরুমের মাধ্যমে তাদের অধিক্ষেত্রে স্থানীয় পূজা কমিটি, জনপ্রতিনিধি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করছে। র্যাব সদর দপ্তর সার্বিক কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।