শিক্ষকদের টানা আন্দোলন-লড়াইয়ের মুখে অবশেষে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের ১৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দুই ধাপে কার্যকর হবে এই সিদ্ধান্ত। এরমধ্যে সাড়ে ৭ শতাংশ (ন্যূনতম ২ হাজার টাকা) কার্যকর হবে চলতি বছরের পহেলা নভেম্বর থেকে। বাকি সাড়ে ৭ শতাংশ কার্যকর হবে আগামী বছরের পহেলা জুলাই থেকে। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আন্দোলন স্থগিত করে আজ বুধবার থেকে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। আন্দোলনে বিগত দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবারও বিশেষ ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষকরা। আর শিক্ষকদের এই দাবি আদায় হওয়ায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আববার। অন্যদিকে বাসা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর শিক্ষকরা নবউদ্যমে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কথা জানায়। এর আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের ৫ শতাংশ (ন্যূনতম ২ হাজার টাকা) বাড়ানো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন শিক্ষক-কর্মচারিরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এই মুহূর্তটা শিক্ষা বিভাগের জন্য সত্যিই ঐতিহাসিক। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য চলতি বছরের ১ নভেম্বর থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া (ন্যূনতম ২ হাজার টাকা) এবং ২০২৬ সালের জুলাই থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মোট ১৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া কার্যকর হবে।
শিক্ষকদের দাবি অনুযায়ী, শতাংশ হারে এই ভাতা নিশ্চিত করতে পেরে একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, শিক্ষকেরা আরও অধিক সম্মানের দাবিদার এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্রের সচেষ্ট থাকা দরকার।
উপদেষ্টা বলেন, এই পথ সহজ ছিল না। নানা মতভেদ, বিতর্ক, অভিযোগÑ সবকিছুই ছিল। কোনো বিতর্কের উত্তর না দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ক্রমাগত একটা ন্যায্য, টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে গেছে। শিক্ষা উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, উপদেষ্টা পরিষদ, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কাজ করে গেছে, যেন শিক্ষকদের দাবি শোনা হয়, বোঝা হয়।
তিনি বলেন, ‘এটি কারো একার জয় নয়; এটি যৌথ সাফল্য। শিক্ষকদের আন্দোলন তাদের বাস্তবতা বুঝিয়েছে, সরকার দায়িত্বশীলভাবে সাড়া দিয়েছে। আর সবাই মিলে আজ এমন এক অবস্থানে এসেছি, যেখানে সম্মান, সংলাপ আর সমঝোতাই জিতেছে। এখন সময় ক্লাসে ফিরে যাওয়ার, শিক্ষার্থীদের কাছে, আসল কাজের জায়গায়। এই সমঝোতা হোক নতুন সূচনা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া ও শিক্ষাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর গুণগত মানসম্মত শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে বাংলাদেশকে আমরা একটি মর্যাদাসম্পন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে পারব।’
বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর দুপুরে শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলনে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সভাপতি এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারী ফোরামের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসাইন আজিজী বলেছেন, আমাদের বড় দাবি পূরণ হয়েছে। এটা আমাদের বড় বিজয়। আন্দোলন করে প্রজ্ঞাপন নিয়ে বাড়ি ফিরছি। আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করছি। আগামীকাল (আজ) থেকে শ্রেণিকক্ষে ফিরছি।
তিনি বলেন, গত ৮ দিন শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে যেতে পারেননি। এটা আমাদের ন্যায্য দাবি ছিল। বার্ষিক পরীক্ষার আগ পর্যন্ত শনিবার স্কুল খোলা রাখব। যে আট দিন শ্রেণিকক্ষে যেতে পারিনি, সেই আট দিন পুষিয়ে দেব। এ সময় দাবি আদায়ে পাশে থাকার জন্য বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
আন্দোলনের মুখে সরকার বাসা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নবউদ্যমে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি নিয়ে গত কয়েকদিন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন উপদেষ্টার সাথে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি যৌক্তিক বলে মনে করে। তবে বাস্তবতা হলো, ১৫ বছরের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গতিশীল হলেও এখনই মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির মতো সামর্থ্য অর্থনীতিতে ফেরেনি। তাই সরকারকে বাস্তবতার নিরীখে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, আন্দোলনরত শিক্ষকরা নবউদ্যমে শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে অবদান রাখবেন।
প্রসঙ্গত, তিন দফা দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের ব্যানারে গত ১২ অক্টোবর থেকে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। সেদিন সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু হলেও দুপুরে পুলিশের অনুরোধে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চলে যান। ওইদিন দুপুরে শিক্ষকদের একটি অংশের ওপর পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে, জলকামানের পানি ছিটিয়ে এবং লাঠিপেটা করে তাদের সরিয়ে দেয়। শিক্ষকদের ওপর ‘পুলিশের হামলার’ প্রতিবাদে সোমবার থেকে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগাতার কর্মবিরতি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও শহীদ মিনার, শাহবাগ, হাইকোর্ট এলাকায় নানা কর্মসূচি পালন করেন তারা। অবশেষে সরকারের ১৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণায় শেষ হলো আন্দোলন।