ঋতু পরিবর্তন আমাদের দেশের এক চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। দুই মাস পরপর ঋতু বদলের নিয়ম হলেও কখনো কখনো একটি ঋতুর ব্যাপ্তি দীর্ঘতর হয়। যেমন আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল হলেও বৃষ্টির ধারা চলে প্রায় অক্টোবরের মাঝামাঝি বা আর্শ্বিন মাস পর্যন্ত। তারপর বর্ষা বিদায় নেয়, শুরু হয় শীতের আবহ। এই দুইয়ের মাঝামাঝি সময়ে আবহাওয়ার মধ্যে ঘটে বড় ধরনের তারতম্য। কখনো রোদ, কখনো মেঘলা, দুপুরে গরম, রাতে হালকা শীত, ভোরবেলায় কুয়াশা, তাপমাত্রায় এই উঠেপড়ার মধ্যেই এমন অস্থির পরিস্থিতিতে শিশুরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়। কারণ তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড়দের চেয়ে কম থাকায় পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তারা বারবার সর্দি-কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, অ্যালার্জি বা ত্বকের রোগে ভুগে। এই সময়ে শীতের প্রস্তুতি হিসেবে পরিবারের সবাই আলমারি বা বাক্স থেকে সোয়েটার, কম্বল কিংবা উলের জামাকাপড় নামায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কাপড়ে ধুলো জমে থাকে ও জন্ম নেয় অদৃশ্য মাইট। হঠাৎ সেই কাপড় শিশুদের গায়ে পরালে তাদের হাঁচি, কাশি, অ্যালার্জি, হাঁপানি বা শিশুর ত্বকে ফুসকুড়ি, চুলকানি বাড়াতে পারে। তাই চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন- শীতের কাপড় ব্যবহার করার আগে ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া জরুরি। এতে মাইট ও ধুলোবালি দূর হয় এবং অসুখের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। শুধু কাপড়ের ব্যাপারেই নয়, এ সময় শিশুদের সুস্থ রাখতে আরও কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করা দরকার।
যেমন-
খাবার ও পানি:
আবহাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসের সক্রিয়তা বেড়ে যায়। যা শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগে আক্রমণ করতে পারে। তাই শিশুদের অবশ্যই স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দেওয়া উচিত। বাইরে বিক্রি হওয়া খাবার, অপরিষ্কার ফল বা ফ্রিজে রাখা ঠান্ডা খাবার শিশুদের দেওয়া ঠিক নয়। যতটা সম্ভব গরম খাবার খাওয়ালে ভালো, এতে উল্লেখিত রোগের পাশাপাশি পেটের অসুখের ঝুঁকিও কমে।
পরিচ্ছন্নতা:
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি। প্রতিদিন গোসল না করালেও অন্তত শরীর ভালোভাবে মুছে দেওয়া দরকার। হাত-পা পরিষ্কার না রাখলে জীবাণু দ্রুত ছড়ায়। বিছানার চাদর, বালিশের কভার, মশারি, সব নিয়মিত ধুয়ে ব্যবহার করতে হবে। ঘরে ধুলো জমে থাকলে শিশুর অ্যালার্জি ও কাশি বাড়ে।
পোশাক:
পোশাক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। দিনের বেলা গরম, রাতে ঠান্ডা। এই অবস্থায় একেবারে ভারী জামা পরোনো ঠিক নয়। বরং আবহাওয়ার সঙ্গে মিল রেখে জামা-পোশাক দিতে হবে, যাতে প্রয়োজনমতো খুলতে বা পড়তে পারে। শিশুর গায়ে ঘাম হলে জামা পাল্টে দেওয়া জরুরি। ভেজা জামা শরীরে ঠান্ডা লাগায়।
খেলাধুলা:
সকালের কুয়াশা বা রাতের ঠান্ডা বাতাসে দীর্ঘ সময় বাইরে রাখা ঠিক নয়। তবে দুপুরে রোদে খেলতে দেওয়া উপকারী, এতে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
স্কুল যাতায়াত:
এ সময়ও সতর্কতা জরুরি। শিশুর ব্যাগে পানির বোতল ও বাসায় তৈরি খাবার রাখা ভালো। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে শুকনো জামা পরাতে হবে। অসুস্থ শিশুকে জোর করে স্কুলে পাঠানো উচিত নয়, এতে সংক্রমণ অন্য শিশুদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অনেক মায়েদের বলতে শুনি- ‘শীতের শুরুতেই আমার বাচ্চা হঠাৎ করে কাশতে শুরু করে। আগে বুঝতাম না কেন হয়। ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তিনি বললেন, আলমারির কাপড় আগে ধুয়ে রোদে না শুকিয়ে ব্যবহার করলে এমন হয়। এখন থেকে কাপড় বের করে তাই করি, তারপর ব্যবহার করি। এখন অসুখ অনেক কমেছে।’ শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘বর্ষার বিদায় ও শীতের আগমনের সময় শিশুদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন শরীর মানিয়ে নিতে পারে না। তাই স্বাস্থ্যকর খাবার, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও নিয়মিত চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ।’
ঋতু পরিবর্তন থামানো যায় না, এটি প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু সচেতনতা বাড়িয়ে এর প্রভাব কমানো সম্ভব। কাপড় পরিষ্কার রাখা, খাবার ও পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ঘরে আলো-বাতাস চলাচল করা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ; এসব মিলিয়ে শিশুরা অনেকটাই নিরাপদ থাকে। এভাবেই মৌসুমি রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়টুকুতে সতর্ক থাকলে পুরো শীতকাল শিশুরা অনেকটাই নিশ্চিন্তে কাটাতে পারে। একটি সুস্থ শিশু মানে একটি সুখী পরিবার। আর সুস্থ পরিবার মিলেই গড়ে তুলে সুস্থ সমাজ। তাই মৌসুম পরিবর্তনের এই সংবেদনশীল সময়ে প্রতিটি পরিবারের দায়িত্ব হলো শিশুদের জন্য বাড়তি সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
লেখক: শিক্ষক ও সংবাদকর্মী