শরৎ পেরিয়ে হেমন্তে যখন বাতাসে পাওয়া যায় হালকা শীতের ছোঁয়া, তখনই বাংলার কৃষকদের মাঝে শুরু হয় শীতকালীন ফসলের প্রস্তুতি। বছরের এই সময়টা যেন কৃষকের নতুন স্বপ্ন বোনার সময়। হেমন্তকালে জমিতে যে পরিশ্রম হবে, তার ফল মিলবে আগামী শীতে। কৃষকদের কাছে তাই এখনই সঠিক সময় চাষাবাদের পরিকল্পনা করার।
শীতকাল বাংলাদেশের কৃষির জন্য আশীর্বাদের মৌসুম। এ সময় পোকার আক্রমণ কম হওয়ায় ফসলের রোগ তুলনামূলক কম হয়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকে। তা ছাড়া এ সময় বাজারে নানা শাক-সবজির চাহিদাও থাকে প্রচুর। শীতের সবজিগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, মুলা, গাজর, লাউ, শসা, বেগুন, লালশাক, পালংশাক, ধনেপাতা ইত্যাদি। সবই পুষ্টিগুণে ভরপুর ফসল।
শীতকালীন সবজি চাষ করে কৃষক লাভবান
হতে পারেন। তবে শীতকালীন চাষের আসল সাফল্য নির্ভর করে আগাম প্রস্তুতির ওপর। হেমন্তের এই সময়টায় কৃষকের প্রধান কাজ হচ্ছে জমি ঠিকভাবে তৈরি করা। বৃষ্টির পানি নেমে গেলে জমি চাষের উপযোগী করতে হয়। এখন যেহেতু বৃষ্টি কমে গেছে তাই আবাদের জমি দুই-তিনবার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে, যাতে বীজ অঙ্কুরোদ্গমে সুবিধা হয়। অনেক জায়গায় এখনো জমিতে আগের মৌসুমের ফসলের অবশিষ্টাংশ রয়ে গেছে। সেগুলো আগে পরিষ্কার করা উচিত। সেগুলো পরিষ্কার না করলে পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। তাই জমি পরিষ্কার রাখাও অত্যন্ত জরুরি।
বীজ বাছাই ও বপন
শীতের ফসলের জন্য ভালো মানের বীজ বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয়ভাবে মানসম্মত বীজ না পেলে সরকারি কৃষি অফিস বা আশপাশের অনুমোদিত দোকান থেকে বীজ সংগ্রহ করা উচিত। সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে নভেম্বরের প্রথম দিক পর্যন্ত সময়টা শীতকালীন সবজির বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। কিছু ফসল যেমন ফুলকপি ও বাঁধাকপি একটু ঠান্ডা সহ্য করতে পারে, কিন্তু টমেটো বা বেগুনের ক্ষেত্রে হালকা উষ্ণ তাপমাত্রা দরকার হয়। তাই এলাকার আবহাওয়া বিবেচনা করে ফসল নির্বাচন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা
আরেকটা বিষয় অনেকেই সেভাবে খেয়াল করেন না। ফসল ভালো হওয়ার মূল রহস্য লুকিয়ে থাকে কিন্তু জমির উর্বরতায়।
তাই কৃষকদের এই বিষয়ে ভালোমতো খেয়াল রাখা উচিত। জমিতে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণগত মান অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া গোবর সার, ভার্মিকম্পোস্ট বা পচা পাতার সার জমিতে মেশালে মাটির গঠন উন্নত হয় এবং শিকড় শক্ত হয়। পাশাপাশি ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সারের সঠিক অনুপাত বজায় রাখলে ফলনও তুলনামূলক বাড়ে। হেমন্তকালে বৃষ্টিপাত কমে যায়, তাই সেচের ব্যবস্থাও করতে হয় আগেভাগে। তবে অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে গাছ পচে যেতে পারে। তাই জমির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন
যদিও শীতকাল তুলনামূলক রোগবালাই কম হয়, তবুও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। পাতার দাগ, ছত্রাকজনিত পচন বা পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ জরুরি। প্রাথমিক অবস্থায় জৈব কীটনাশক যেমন নিমপাতার রস বা ট্রাইকোডার্মা ব্যবহার করা যেতে পারে। একদম শেষ পর্যায়ে না পৌঁছালে রাসায়নিক কীটনাশকের প্রয়োজন পড়ে না। অভিজ্ঞতা না থাকলে সেক্ষেত্রে কৃষিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আবাদে বৈচিত্র্য আনা
বর্তমানে অনেক কৃষকই মিশ্র চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এক জমিতে একাধিক ফসল যেমন গাজর, পেঁয়াজ ও লালশাক একসঙ্গে চাষ করলে জমির ব্যবহার বাড়ে, আয়ও বেশি হয়। তা ছাড়া এক ফসল ব্যর্থ হলেও অন্য ফসল থেকে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়। শীতকালীন মৌসুমে এই মিশ্র চাষের পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
কৃষকের লাভ
শীতকালীন সবজি দ্রুত বিক্রিযোগ্য এবং বাজারমূল্যও সাধারণত ভালো থাকে। তাই ছোট জমিতেও এই সময়ে চাষ করলে কৃষকের হাতে নগদ অর্থ আসে, যা পরবর্তী মৌসুমের চাষে কাজে লাগে। তা ছাড়া সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবারেও পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়। এক কথায় শীতকাল কৃষকের আর্থিক ও পুষ্টিগত স্বস্তির সময়।