বুয়েট শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি হত্যা মামলায় মুশফিক উদ্দিন টগর (৫০) কারাভোগ শেষে অস্ত্র ব্যবসায় জড়ান বলে জানিয়েছে র্যাব। গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর লালবাগ থানাধীন আজিমপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে টগরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব বলেছে, সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অবৈধভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে ঢাকায় এনে বিভিন্ন মানুষকে সরবরাহ করতেন টগর। সনি হত্যা মামলায় সাজাভোগের পর টগর ২০২০ সালের ২০ আগস্ট কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে ৩২ এমএম ১টি রিভলবার, ১টি ম্যাগাজিন, ১টি কাঠের পিস্তলের গ্রিপ, ১৫৫ রাউন্ড .২২ রাইফেলের গুলি, ১টি ৭.৬২ এমএম মিসফায়ার গুলি, ১টি শটগানের খালি কার্তুজ, মানুষের মুখাবয়বের দুটি মুখোশ ও ২টি মোবাইল জব্দ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন জানান, সনি হত্যা মামলায় দীর্ঘ কারাভোগ শেষে ২০২০ সালে মুক্তি পান টগর। মুক্তির পর থেকেই তিনি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অস্ত্র এনে ঢাকায় সরবরাহ করে আসছিলেন।
তিনি বলেন, টগরকে গ্রেপ্তারের প্রথমে আমরা সনি হত্যার বিষয়টা মূল্যায়ন করিনি। আমরা অস্ত্র উদ্ধারে গিয়েছিলাম, পরে অবগত হই তিনি ওই মামলার আসামি। টগর সনি হত্যা মামলায় প্রথম গ্রেপ্তার হন ২০০২ সালের ২৪ জুন।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী আমাদের অস্ত্র উদ্ধারের কার্যক্রম চলমান থাকবে।
এক প্রশ্নের জবাবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন বলেন, সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে বুঝতে পারি, তার কাছে আরও অস্ত্রের সন্ধান থাকতে পারে। মাত্র গতকালই তাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আমরা কিছু নম্বর পেয়েছি, সেগুলো নিয়ে কাজ করব।
রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, যিনি অপরাধী, তিনি অপরাধীই। তাকে কোনো দলও গ্রহণ করে না। আমরা তাকে অপরাধী হিসেবেই বিবেচনা করছি। তার কাছে যা পাচ্ছি, সেটার বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত করছি।
টগরের বিরুদ্ধে মুগদা থানায় একটি মাদকের মামলা রয়েছে জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা আরেফীন বলেন, সনি হত্যা মামলায় সাজাভোগের পর তিনি মুক্তি পান। বর্তমানে অস্ত্র মামলায় নতুনভাবে তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হবে। টগর অস্ত্র এনে কাকে দিয়েছেন, সে তথ্য পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, ২২ বছর আগে ২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েটের কেমিপ্রকৌশল বিভাগের ১৯৯৯ ব্যাচের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি সেদিন ক্লাস শেষে বুয়েটের হলে ফিরছিলেন। কিন্তু হলে আর তার ফেরা হয়নি, ফিরেছেন রক্তমাখা লাশ হয়ে। সনি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার পর সারা দেশে আন্দোলন হয়।
২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েট ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি মোকাম্মেল হায়াত খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের তৎকালীন ছাত্রদল নেতা মুশফিক উদ্দিন টগর গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হন সনি। দরপত্র নিয়ে ওই সংঘর্ষ হয়।
এত বছর পরও আলোচিত ওই হত্যা মামলার প্রধান দুই আসামি ছিলেন পলাতক। মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার না হওয়ার আক্ষেপ নিয়েই গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি মারা যান সনির বাবা হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া। তিনি ব্লাড ক্যানসারে ভুগছিলেন। সনির মা দিলারা বেগম এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
ঢাকার বিচারিক আদালতে সনি হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয় ২০০৩ সালের ২৯ জুন। রায়ে ছাত্রদলের নেতা মুশফিক উদ্দিন টগর, মোকাম্মেল হায়াত খান ওরফে মুকিত ও নুরুল ইসলাম ওরফে সাগরকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। এ ছাড়া পাঁচজনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-। পরে ২০০৬ সালের ১০ মার্চ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত তিনজনের সাজা কমিয়ে তাদেরও যাবজ্জীবন কারাদ- দেন উচ্চ আদালত। পাশাপাশি যাবজ্জীবন দ- পাওয়া পাঁচ আসামির মধ্যে দুজনকে খালাসও দেওয়া হয়। ওই হত্যাকা-ে দ-িত ছয় আসামির মধ্যে চারজন কারাগারে আছেন। মোকাম্মেল ও নুরুল এখনো পলাতক। তবে আসামি মুশফিক উদ্দিন টগর কারাভোগের পর মুক্ত ছিলেন। তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হলো। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা সনি হত্যার দিনটিকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী দিবস’ হিসেবে পালন করেন। এ ছাড়া সনি মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেও সনির মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন