পৃথিবী যেন ক্রমেই মানবতার পরীক্ষা ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ, দুর্ভিক্ষে শিশুদের কঙ্কালসার দেহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভেসে যাওয়া গ্রাম এবং শরণার্থীর দীর্ঘ মিছিল, সব মিলিয়ে মানবতার চিত্র ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্ক্রিনে কিংবা অনলাইন নিউজ পোর্টালের শিরোনামে দেখতে হয় অসহায় মানুষের মুখ। গাজা থেকে সুদান, ইউক্রেন থেকে ইয়েমেন যেখানেই তাকাই, মানবতার আর্তনাদ কানে ভেসে আসে। এই পরিস্থিতিতে মানবতার পথ কোথায়?
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৬ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে যুদ্ধ ও সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত লাখ লাখ মানুষকে ঘরছাড়া করেছে, গাজায় বোমাবর্ষণে ধ্বংস হয়ে গেছে হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্র। সুদানে গৃহযুদ্ধের কারণে প্রায় এক কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে, আফ্রিকার বেশকিছু অঞ্চলে খরা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবিকা হারাচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। এমনকি অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বহু মানুষ খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে দিন কাটাচ্ছে।
মানবিক সহায়তার চাহিদা যত বাড়ছে, তহবিল ও সহায়তার হাত ততই সংকুচিত হয়ে আসছে। উন্নত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকায় আন্তর্জাতিক অনুদান ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে খাদ্য, ওষুধ, আশ্রয় ও শিক্ষা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এই খবরগুলোই আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, মানবতা কি শুধুই বক্তৃতা আর দিবস উদযাপনের মধ্যে আটকে আছে, নাকি সত্যি সত্যিই আমরা একে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে অসংখ্য মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের সময়, শ্রম ও অর্থ দিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করা, শরণার্থী ক্যাম্পে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো কিংবা দুর্যোগপীড়িত গ্রামে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া। এসব উদ্যোগ প্রমাণ করে, সহমর্মিতার আলো নিভে যায়নি। কিন্তু এই আলোকে টেকসই করতে হলে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বয় জরুরি। শুধু সংকটকালে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে মানবতার ভবিষ্যৎ রক্ষা করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। আমাদের দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙনে হাজারো পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা কৃষিজীবীদের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলছে। এর পাশাপাশি কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর দায়িত্ব বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে। সীমিত সম্পদ নিয়েও বাংলাদেশি জনগণ মানবিক সহায়তার যে উদাহরণ স্থাপন করেছে, তা প্রশংসনীয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে বহন করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এই সংকট সমাধান অসম্ভব।
মানবতার এই সংগ্রামে প্রযুক্তিও একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিত্তিতে কোনো দুর্যোগ বা সংঘাতের খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়ায়। অনলাইন ক্যাম্পেইন, ক্রাউডফান্ডিং কিংবা ডিজিটাল ভলান্টিয়ারিং আজ মানবিক সহায়তার নতুন দিগন্ত। আবার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম পূর্বাভাস দিয়ে জীবন রক্ষা করা সম্ভব। তবে একই সঙ্গে ভুয়া খবর, নেতিবাচক প্রচারণা এবং তথ্যের অপব্যবহার মানবতার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই প্রযুক্তি যেমন মানবতার আলোকবর্তিকা হতে পারে, তেমনি সঠিক ব্যবহার না হলে তা বিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে। মানবতার সংগ্রামের এই হাতিয়ারকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করব সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরকে নিতে হবে।
মানবতার স্থায়ী রূপ নিশ্চিত করতে যুবসমাজের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী প্রজন্মই মানবতার প্রকৃত রক্ষক। বিশ্বের যে প্রান্তেই মানবিক সংকট দেখা দিক না কেন, তরুণরা সেখানে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে এবং রাখছেও। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্ম এখন স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের অগ্রদূত হয়ে উঠেছে। তাদের সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তি-জ্ঞান ব্যবহার করে মানবিক সহায়তার নতুন দিগন্ত তৈরি করা সম্ভব। মানবতার পথ খুঁজে পেতে হলে আমাদের তিনটি দিক মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, প্রতিটি মানুষের জীবনের মর্যাদা রক্ষা করা, দ্বিতীয়ত বৈষম্য ও সহিংসতার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা এবং তৃতীয়ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সবার জন্য নিশ্চিত করা। কারণ ক্ষুধার্ত মানুষকে একদিন খাবার দেওয়া মানবিক কাজ হলেও, তাকে স্বাবলম্বী করে তোলা মানবতার স্থায়ী রূপ। বিশ্বের যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাগুলোতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের যৌথ উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা গেলে আমরা হয়তো অনেক বড় সংকট প্রতিরোধ করতে পারব।
মানবিক সহায়তার ভবিষ্যৎ টেকসই করতে হলে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে। শুধু আন্তর্জাতিক অনুদানের ওপর নির্ভর করলে সংকট আরও বাড়বে। তাই স্থানীয় কমিউনিটি ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র তহবিল গঠন এবং স্বনির্ভর উন্নয়নমূলক কর্মসূচি চালু করা জরুরি। যেমন দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় স্থানীয় মানুষের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা, নিরাপদ আশ্রয় এবং বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা আগেভাগে নিশ্চিত করা গেলে আন্তর্জাতিক সহায়তার চাপ অনেকটাই কমবে। একইসঙ্গে বেসরকারি খাতকেও মানবিক সহায়তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (ঈঝজ) কর্মসূচি কেবল দান বা অনুদান নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক বিনিয়োগের সুযোগ হতে পারে। কোম্পানিগুলো যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে বিনিয়োগ করে তাহলে তা শুধু সমাজকে নয়, ভবিষ্যতের দক্ষ জনশক্তি তৈরিতেও সহায়তা করবে।
তরুণ প্রজন্মকে এই যাত্রায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রযুক্তি এবং নতুন আইডিয়া ব্যবহারে দক্ষ। তাই অনলাইন ফান্ডরেইজিং, সচেতনতা ক্যাম্পেইন, ভলান্টিয়ার নেটওয়ার্ক তৈরি কিংবা প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান বের করার মাধ্যমে তরুণরা মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রটিকে আরও গতিশীল করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিভিন্ন তরুণ সংগঠন যদি মানবিক প্রকল্প হাতে নেয়, তবে নতুন প্রজন্ম কেবল দর্শক নয় বরং পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। এ ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতা, সহমর্মিতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। পাঠ্যবইয়ের বাইরে বাস্তব অভিজ্ঞতা যেমন কমিউনিটি সার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুত হবে। এই প্রজন্মই আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে, তাই তাদেরকে মানবতার পথচলার নেতৃত্বের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সহায়তার হাত যদি টেকসই করা যায়, এবং তার সঙ্গে যদি শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিকে যুক্ত করা যায়, তবে ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে আরও মানবিক, আরও নিরাপদ। কারণ প্রতিটি সহায়তার পদক্ষেপই শুধু একজন মানুষের জীবন বাঁচায় না, বরং সমগ্র মানবতার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এটাই আমাদের চাওয়া, যেখানে মানবতা সীমান্তের বেড়া মানবে না, ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতির দেয়ালে আটকে যাবে না। গাজার একটি শিশুর কান্না ইউরোপের কোনো শহরের মানুষকেও ভাবিয়ে তুলবে, আফ্রিকার খরাপীড়িত এক মায়ের দুর্দশা এশিয়ার তরুণকেও সাহায্যের হাত বাড়াতে অনুপ্রাণিত করবে। যদি আমরা সবাই মিলে ছোট ছোট পদক্ষেপ নেই, তাহলে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ আর সংকটের অন্ধকারে মানবতার পথ খুঁজে পেতে হলে আমাদেরকেই আলো জ্বালাতে হবে। সেই আলো আসতে পারে প্রতিটি মানুষের ভেতরের সহমর্মিতা থেকে। মানবতা কোনো একক সংগঠন, দেশ বা ব্যক্তির দায়িত্ব নয়। এটি আমাদের সবার। আমরা যদি এই সত্য মেনে কাজ করি, তাহলেই হয়তো একদিন পৃথিবীর প্রতিটি শিশুর চোখে ভয়ের বদলে আশার আলো দেখতে পাব এবং সেই দিনই প্রমাণ হবে, মানবতার পথ এখনো বেঁচে আছে।
মালিহা মেহনাজ
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়