ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত যুবসমাজ

স্বপন বিশ্বাস, শালিখা, মাগুরা
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫, ১১:৩৪ এএম
অনলাইন জুয়া

আজকের তরুণ প্রজন্ম এমন এক যুগে বেড়ে উঠছে যেখানে প্রযুক্তি তাদের জীবনকে সহজ ও সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি বিপজ্জনকও হয়ে উঠেছে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন গেম, সবই তাদের হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে শিক্ষার, সৃজনশীলতার ও সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। কিন্তু একই প্রযুক্তি আজ এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ, অনলাইন জুয়া।

সাধারণত বিনোদন বা কৌতূহলের নামে শুরু হলেও, অনলাইন জুয়া অল্প সময়ের মধ্যে যুবসমাজের জীবন ও ভবিষ্যৎকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এটি শুধুই অর্থ হারানোর বিষয় নয়; সময়, মনোযোগ, শিক্ষাজীবন এবং মানসিক স্বাস্থ্যও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনলাইন জুয়ার আকর্ষণ মূলত সহজ অর্থ উপার্জনের প্রলোভন। একটি ক্লিকে লটারি, বেটিং বা ক্যাসিনোতে অংশ নেওয়া যায়। প্রথমদিকে সামান্য লাভ হলেও, দ্রুত আসক্তি তৈরি হয়। খেলোয়াড়রা বুঝতে পারে, তারা শুধু অর্থই হারাচ্ছে না, বরং নিজের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎকেও ঝুঁকিতে ফেলছে।

শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বড় শিকার। রাত জেগে তারা বইয়ের পরিবর্তে মোবাইল স্ক্রিনে জুয়ার সাইট ঘাঁটে। পরীক্ষার ফল খারাপ হয়, শিক্ষাজীবন ভেঙে পড়ে। পরিবার থেকে নেওয়া টাকার বাইরে খরচ মেটাতে তারা চুরি, প্রতারণা বা ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অনেকের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়; হতাশা, উদ্বেগ ও বিষণœতার বৃদ্ধি ঘটে। সমাজে আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি- অনলাইন জুয়ার কারণে আত্মহত্যা ও অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এটি শুধুই ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, পরিবারের ভাঙন এবং সমাজের নিরাপত্তার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

তরুণরা কেন এত সহজে এই নেশায় জড়িয়ে পড়ে? তিনটি প্রধান কারণ দেখা যায়। প্রথম, সচেতনতার অভাব। তারা মনে করে, এটি কেবল খেলা বা বিনোদন। দ্বিতীয়ত, অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহার। রাতদিন মোবাইলে ব্যস্ত থাকার কারণে তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তৃতীয়ত, পরিবার ও সমাজে পর্যাপ্ত নজরদারি নেই। বাবা-মা সন্তানদের অনলাইন ব্যবহার পর্যবেক্ষণ না করলে আসক্তি গড়ে ওঠে অজান্তেই।এ থেকে মুক্তির পথ রয়েছে। প্রথমত, পরিবার সচেতন হতে হবে।

সন্তান কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, কতক্ষণ অনলাইনে সময় দিচ্ছে, এসব বিষয়ে নজর রাখা জরুরি। খোলামেলা আলোচনা এবং মানসিক সমর্থন তরুণদের এই ফাঁদ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুল ও কলেজে অনলাইন জুয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়ে সেমিনার, কর্মশালা ও আলোচনা সভা আয়োজন করা উচিত। শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ অপরিহার্য। অবৈধ অনলাইন ক্যাসিনো, বেটিং সাইট ও অ্যাপ চিহ্নিত করে বন্ধ করতে হবে। আইটি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

চতুর্থত, তরুণদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। অনলাইন জুয়া কেবল অর্থ নয়, জীবনকেও ধ্বংস করে, এটি তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিকল্প বিনোদনের পথ যেমন খেলাধুলা, সাহিত্য, সংগীত বা সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করানো অত্যন্ত জরুরি।

যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ না নেই, অনলাইন জুয়ার আগ্রাসন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপথে ঠেলে দেবে। ঠিক যেমন একসময় মাদক সমাজে ভয়াল থাবা বসিয়েছিল, অনলাইন জুয়াও সমানভাবে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। প্রযুক্তি আমাদের শত্রু নয়, বন্ধু। তবে সঠিক ব্যবহারের অভাবে সেটি সর্বনাশের কারণও হতে পারে।

সময়ের দাবি, একটি সুস্থ, সচেতন ও নিয়ন্ত্রিত সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে তরুণরা তাদের প্রতিভা কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার, আমরা কি প্রযুক্তিকে উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করব, নাকি অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে নিজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেব?