ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

বিমানবন্দরের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা: এক করুণ বাস্তবতা ও করণীয়

মুনাওয়ার হোসাইন মইনুল, গণমাধ্যম উদ্যোক্তা
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৫, ০২:২৯ এএম

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে স্তব্ধ দেশ

গত ১৮ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুরো দেশ স্তব্ধ। দুদিন পরেও ধোঁয়া উঠছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে তদন্ত চলছে। তারা বলেন, কার্গো ভিলেজে খোপ খোপ ঘরে মালামাল গাদাগাদি করে রাখায় আগুন নেভানো কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে এই খোপগুলো কি ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনে তৈরি? তদারকি বা দায় নেবে কে? অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে শত কোটি টাকার ক্ষতি, আর হাজারো ব্যবসায়ী আজ নিঃস্ব হওয়ার পথে। এমন বিপর্যয় রোধে কার্যকর নিরাপত্তা তদারকি ও জবাবদিহি এখন সময়ের দাবি।

আন্তর্জাতিক মানের বাইরে নিরাপত্তা

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার শাহজালাল বিমানবন্দর প্রতিদিন হাজারো যাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিমান চলাচলের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ জ্বালানি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও যান্ত্রিক উপকরণ ব্যবহৃত হয়Ñ যা অগ্নিকা-ের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ফলে এমন স্থানে একটি আধুনিক, সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তবতা ভয়াবহভাবে ভিন্ন।

এই তো কিছুদিন আগেই দেশের একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে (আমাদের সময়, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫) ‘ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকি বিমানের হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রায় পাঁচ বছর ধরে অচল পড়ে আছে পুরো অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা। ছয়টি ফায়ার পাম্প, ফোম লাইন ও ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র সচল না থাকায় কোটি কোটি টাকার বিমান, যন্ত্রাংশ ও শতাধিক কর্মীর জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে।’

আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী সচল ফায়ার সিস্টেম বাধ্যতামূলক হলেও বছরের পর বছর তা উপেক্ষিত রয়েছে। ২৫ বছর আগের দুর্বল ও অকার্যকর অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়েই চলছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্স। এমনকি হঠাৎ আগুন লাগলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধের কোনো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা নেইÑ যা একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য অকল্পনীয়।

সেন্সরগুলো ধোঁয়া, তাপ বা আগুন শনাক্ত করলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বাজে, কেন্দ্রীয় ফায়ার কন্ট্রোল স্টেশনে সংকেত পাঠায় এবং পাম্প হাউসে পানি সরবরাহের নির্দেশ দেয়Ñ এভাবেই মুহূর্তের মধ্যে আগুন মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই মৌলিক ব্যবস্থাটিই এখন অচল অবস্থায়।

যদিও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ও বিমানের কর্মকর্তারা বিষয়টির কিছু অংশে দ্বিমত জানিয়েছেন, তবুও এটি স্পষ্টÑ ফায়ার সার্ভিস, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, এই তিন পক্ষের সমন্বয় ও তদারকির ঘাটতি ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে।

সামাজিক দায়বোধ ও সচেতনতার ঘাটতি

অগ্নিকা-ের সময় অসচেতন জনগণের আচরণও পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। অনেকেই উৎসুক দর্শক হিসেবে ঘটনাস্থলে ভিড় করেন, কখনো কখনো ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কাজে বাধা দেন, গাড়ি ভাঙচুর করেন, এমনকি আহতও করেন। অথচ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ ধরনের উদাহরণ নেই।

আগুন নেভানো একটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। আগুনের ধরন, জ্বালানি উৎস ও গতি প্রকৃতি না বুঝে হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। তাই জনগণের সচেতনতা ও সহযোগিতা নিশ্চিত করাও অগ্নি নিরাপত্তার অপরিহার্য অংশ।

পাশাপাশি সরকারের উচিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগকে আরও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা, তাদের জন্য পর্যাপ্ত আধুনিক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামোর মধ্যে আনা।

আধুনিক বিমানবন্দরের জন্য জরুরি অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা

১. অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ঋরৎব চৎবাবহঃরড়হ ঝুংঃবস):

বৈদ্যুতিক সংযোগ, সার্কিট ও কেবলিং নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। জেট ফুয়েল সংরক্ষণ এলাকা বিস্ফোরণ-নিরোধক হতে হবে। নির্দিষ্ট ‘ঝসড়শরহম তড়হব’ ছাড়া ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রাখতে হবে।

২. অগ্নি শনাক্তকরণ ও সতর্কতা ব্যবস্থা (ঋরৎব উবঃবপঃরড়হ ্ অষধৎস ঝুংঃবস):

টার্মিনাল, কন্ট্রোল টাওয়ার ও হ্যাঙ্গারে স্মোক, হিট ও ফ্লেম ডিটেক্টর স্থাপন করতে হবে। এগুলো যেন ইগঝ ও ঈঈঞঠ-এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।

৩. অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা (ঋরৎব ঝঁঢ়ঢ়ৎবংংরড়হ ঝুংঃবস):

জ্বালানি ট্যাংক এলাকায় ফোম স্প্রিংকলার, সার্ভার রুমে ঈঙ₂ বা ক্লিন এজেন্ট সিস্টেম ব্যবহার আবশ্যক। প্রতিটি জোনে পোর্টেবল এক্সটিংগুইশার রাখতে হবে।

৪. অগ্নি নির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযান (ঋরৎবভরমযঃরহম ্ জবংপঁব):

বিমানবন্দরের ফায়ার ইউনিটকে ওঈঅঙ মান অনুযায়ী সাজাতে হবে। জরুরি পরিস্থিতিতে তিন মিনিটের মধ্যে সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে।

৫. নিরাপদ নির্গমন পরিকল্পনা (ঊাধপঁধঃরড়হ চষধহ):

জরুরি নির্গমন চিহ্ন, আলো ও চঅ সিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত ফায়ার ড্রিল আয়োজন করা বাধ্যতামূলক।

৬. নিয়মনীতি ও প্রশিক্ষণ (জবমঁষধঃরড়হং ্ ঞৎধরহরহম):

ওঈঅঙ হহবী ১৪ ও ঘঋচঅ মান অনুসরণ করতে হবে। বছরে অন্তত একবার হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ আবশ্যক।

৭. স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার (ঝসধৎঃ ঋরৎব ঝধভবঃু ওহঃবমৎধঃরড়হ):

ওড়ঞ সেন্সর, ভিডিও অ্যানালিটিকস ও ডিজিটাল টুইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আগুনের ঝুঁকি পূর্বাভাস ও প্রতিক্রিয়া জোরদার করতে হবে।

ভবিষ্যতের জন্য বার্তা

বাংলাদেশে অগ্নি নিরাপত্তা এখনো ‘ঘটনার পর প্রতিক্রিয়া’-নির্ভর, অথচ উন্নত বিশ্বে এটি ‘ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’-কেন্দ্রিক। বিমানবন্দর একটি দেশের মর্যাদার প্রতীকÑ এখানে নিরাপত্তায় অবহেলা মানে রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা।

এখন সময় এসেছে সরকার, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসের যৌথ উদ্যোগে একটি জাতীয় বিমানবন্দর অগ্নি নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন করার।

পরিকল্পনা, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের সমন্বয় ঘটলে ভবিষ্যতে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর ঘটবে না।

আগুন শুধু সম্পদের ক্ষয় নয়, এটি জীবনের ক্ষয়ও ডেকে আনে। তাই সময় থাকতেই সতর্ক হওয়াÑ এই একমাত্র পথ আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার।

মুনাওয়ার হোসাইন মইনুল, গণমাধ্যম উদ্যোক্তা
সভাপতি, মানবাধিকার ও
জলবায়ু- উন্নয়ন সংগঠন