মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রেজাউল করিম, রংপুর

প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৫, ০৮:৫১ এএম

উত্তর অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্য বাঁশশিল্প

রেজাউল করিম, রংপুর

প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৫, ০৮:৫১ এএম

উত্তর অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে  শতবর্ষের ঐতিহ্য বাঁশশিল্প

একসময় গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল বাঁশশিল্প। উঠানজুড়ে সাজানো থাকত বাঁশের তৈরি ডালি, কুলা, ঝুড়ি, চাটাই, হাতপাখা কিংবা মাছ ধরার ফাঁদ। জীবিকা নির্বাহ থেকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সবকিছুতেই ছিল এর উপস্থিতি। কিন্তু আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছে উত্তরবঙ্গের এই শতবর্ষের ঐতিহ্য।

রংপুর বিভাগীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প অধিদপ্তরের তথ্যমতে, একসময় এই অঞ্চলের আট জেলার ১১৪টি গ্রামে প্রায় ৭০ হাজার পরিবার বাঁশশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ হাজারে। চাহিদা হ্রাস, কাঁচামালের সংকট ও বাজার ব্যবস্থার অভাবের কারণে প্রতিদিনই ছোট হয়ে আসছে এ শিল্পের দিগন্ত। প্রতিদিনই কমছে এ শিল্পের ব্যবহার। তাই এ শিল্পের শিল্পীরা এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, এ শিল্প ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।

সরেজমিনে দেখা যায়, একসময় বাঁশ কাটার শব্দে মুখর থাকত রংপুরের গঙ্গাচড়ার বড়বিল ইউনিয়নের মনিরাম গ্রাম। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিল বাঁশের তৈরি হস্তশিল্প- ডালি, কুলা, ঝুড়ি, চাটাই, হাঁস-মুরগি টোপা, মাছ ধরার ফাঁদ, হাতপাখা থেকে শুরু করে নানা প্রয়োজনীয় ও নকশাদার সামগ্রী। এ শিল্পই ছিল গ্রামের অনেক পরিবারের একমাত্র জীবিকা।

মনিরামের প্রবীণ বাঁশশিল্পী আবদুল ওয়াহেদ (৮৫) বলেন, ‘আমার বাবার হাত ধরে এ কাজ শিখেছি। আগে অনেক অভাব অনটন ছিল, এ কাজ করেই আমাদের ১৪ ভাই-বোনের সংসার চালাতেন বাবা। কখনোই হিমশিম খেতে হয়নি তাকে। বাবার আমল থেকে বাঁশের কাজ করছি। আগে যেমন বেচা বিক্রি হতো এখন আর সে রকম হয় না।’

নগরায়ণের দৌড়ে পাল্লা দিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোয়। ফলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন জনবসতি। কমে যাচ্ছে কৃষিজমি ও বনাঞ্চল। গ্রামাঞ্চলে এখন বাঁশ, বন উজাড় করা হচ্ছে। তাই একদিকে বাড়ছে বাঁশের দাম অন্যদিকে কমছে এর সহজলভ্যতা। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঁশশিল্পীদের কর্মসংস্থানে।

মনিরামের বাঁশশিল্পী কেনজুল বলেন, ‘আগে বাঁশশিল্পের সোনালি অতীত ছিল, এখন সেগুলো কেবল গল্প নয়তো স্বপ্ন। আগে বাঁশ পাওয়া যেত ৫০-১০০ টাকায়। এখন কিনতে হয় ৩০০-৪০০ টাকায়। একটা দিয়ে পাশ থেকে ছয়টি মুরগির টোপা তোলা সম্ভব। একটা টোপা আমরা পাইকারদের কাছে বিক্রি করি ১০০ টাকায়। তাহলে সারা দিনের পরিশ্রম করে আমাদের লাভ তেমন থাকে না।’

বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে আসার পর শাশুড়ির কাছে কুলা বানাতে শেখেন হাসনা বেগম। আজ শশুর-শাশুড়ি নেই কিন্তু ধরে আছেন সেই পেশা। ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিকেও দিয়েছেন সেই শিক্ষা। বৃদ্ধা নারীশিল্পী মমেনা  বলেন, ‘এখন সবকিছুরই দাম বেড়েছে। বাঁশ, তার সবকিছুর। এই অবস্থায় এ পেশা টিকিয়ে রাখা খুবই কষ্টকর। আমরা পেশা টিকিয়ে রাখতে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাভের ওপরে টাকা নিই। ১ হাজার টাকায় ১০০ টাকা মাসে লাভ দিতে হয়। ৫ হাজার টাকায় মাসে লাভ দিতে হচ্ছে ৫০০ টাকা। এ ঋণ যেন সংসারের বিরাট বোঝা। কোনো মাসে টাকা দিতে দেরি হলে শুনতে হয় নানা কথা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই জীবিকা আর সহজতর হবে বলে মনে করি।’

এখন আর আগের মতো অর্ডার আসে না। আসে না হাটের আগের রাতের ব্যস্ততা। ফলে গ্রামের অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কেউ দিনমজুরি করেন, কেউ শহরে রিকশা চালান। যারা এখনো এই শিল্প আঁকড়ে ধরে আছেন, তারাও পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়। কারণ পুঁজি নেই, বাজার নেই, আর নেই কোনো সরকারি সহযোগিতা।

বাঁশশিল্পী দুলালী বলেন, ‘বাঁশ কিনে আনতেও এখন অনেক টাকা লাগে। তারপর বানিয়ে বাজারে নিয়ে গেলেও বিক্রি হয় না। ঋণ নিতে চাইলে কেউ দেয় না। হাতেই টাকা নাই, সরকার থেকেও কোনো সাহায্য পাইনি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য লেবু মিয়া বলেন, ‘মনিরামে অনেক প্রতিভাবান বাঁশশিল্পী আছেন। কিন্তু তাদের আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং পণ্য বাজারজাত করার কোনো সুযোগ নেই। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে এই ঐতিহ্য আবারও ফিরে আসতে পারে।’

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের মতে- বাঁশশিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও গ্রামীণ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আধুনিক ডিজাইন, প্রশিক্ষণ ও অনলাইন বিপণন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত করলে এ শিল্প আবারও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের রংপুর উপমহাব্যবস্থাপক এহসানুল হক বলেন, ‘আমাদের উপজেলা পর্যায়ে বিসিকের কোনো অফিস নেই। ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পগুলোর সঙ্গে জড়িত লোকেরা আমাদের সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছেন না। মনিরামের বাঁশশিল্পীদের প্রয়োজন হলে তারা বিসিকে যোগাযোগ করবে, আমরা অবশ্যই তাদের ঋণের ব্যবস্থা করব।’

মনিরামের বাঁশশিল্প এখন শুধুই ইতিহাস হয়ে যাওয়ার পথে। একটু সহানুভূতি, একটু পৃষ্ঠপোষকতা আর আধুনিক চিন্তার ছোঁয়ায় হয়তো এই হারিয়ে যাওয়া শিল্প আবারও জীবিত হতে পারে, একটি গ্রামের আশা হয়ে।

এ চিত্র শুধু রংপুরেই নয়, উত্তরের ৮ জেলা লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়েও। আধুনিকতার কারণে এসব জেলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঁশশিল্প।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!