ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ

ষড়যন্ত্রের নৈরাজ্য মহাসড়কে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৫, ০১:৫৬ এএম
  • শ্রমিক, রাজনৈতিক, শিক্ষার্থী পেশাজীবী সবাই মহাসড়ককে দাবি আদায়ের হাতিয়ার মনে করে
  • মহাসড়ক অবরোধ হলে রোগী, শিশু ও নারীরা ভোগান্তিতে পড়ে
  • গামেন্টস শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা

ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন মহাসড়কে সম্প্রতি শ্রমিক ও রাজনৈতিক অবরোধে জনজীবন এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। বকেয়া বেতন, ন্যায়বিচার, কিংবা দলীয় দ্বন্দ্ব, যেকোনো দাবির হাতিয়ার এখন হয়ে উঠেছে মহাসড়ক অবরোধ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, যারা প্রতিদিন অফিস, ব্যবসা বা জরুরি কাজে রাস্তায় নামেন।

স্থানীয়রা বলছেন, দাবিদাররা জানেন, সড়ক অবরোধ করলেই প্রশাসনের টনক নড়ে। আর তাই, দ্রুত দাবি আদায়ের কৌশল হিসেবে মহাসড়ককে ব্যবহার করা এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।

হালুয়াঘাটে সূচনা, ছড়ালো বিভাগজুড়ে : ঘটনার সূত্রপাত গত ১০ অক্টোবর (শুক্রবার) হালুয়াঘাটে। মুক্তিযোদ্ধা আবু রায়হান ও বাস শ্রমিক ঝন্টুর মধ্যে ধাক্কাধাক্কির পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক ঝন্টুকে আটক করলে, এনসিপি নেতা ও শিক্ষার্থীরা রাতে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন।

এরপর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। প্রতিবাদে শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। দীর্ঘ চার ঘণ্টা মহাসড়ক স্থবির থাকে। বিকেলে প্রশাসনের আশ্বাসে যান চলাচল শুরু হয়।

তবে এর জেরে পরদিন থেকেই জেলার অন্য রুটে ছড়িয়ে পড়ে ধর্মঘট ও অবরোধ। ১২ অক্টোবর ভোর থেকে ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ অভিমুখী সব রুট বন্ধ হয়ে পড়ে। সারা দেশের সঙ্গে ময়মনসিংহের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রোববার রাতে জেলা প্রশাসকের জরুরি সভার পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হলেও, নাগরিক ভোগান্তি ততক্ষণে চরমে পৌঁছে যায়।

ভালুকায় পর পর শ্রমিক বিক্ষোভ: গত ১৩ অক্টোবর ভালুকার কাঠালী এলাকায় শেফার্ড গ্রুপের শ্রমিকরা ১০ দফা দাবিতে সড়ক অবরোধ করেন। ঘণ্টাব্যাপী অবরোধে ১০ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

এর আগে গত ৯ অক্টোবর বেতন বিলম্বের প্রতিবাদে মুনতাজিম স্পিনিং মিলের শ্রমিকরা ভরাডোবা এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। দুই ঘণ্টার অবরোধে ২০ কিলোমিটার রাস্তায় স্থবিরতা দেখা দেয়। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

গত ৫ অক্টোবর ওরিয়ন নিট টেক্সটাইল লিমিটেডের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ, বকেয়া বেতন ও চাকরি হারানোর আশঙ্কায় জামিরদিয়া আইডিয়াল মোড় এলাকায় বিক্ষোভ করেন। প্রায় এক হাজার শ্রমিক রাস্তায় নামেন।

শিশুর দুর্ঘটনা, জনরোষে সড়ক অবরোধ: গত ১৪ অক্টোবর নান্দাইলে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় আহত হয় ৬ বছরের শিশু রিজু চন্দ্র। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা দুই ঘণ্টা ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ রাখেন। ছয় কিলোমিটার যানজটের পর ইউএনও ও পুলিশের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

মুনতাজিম স্পিনিং মিলের অ্যাডমিন ম্যানেজার ইছা আহমেদ জানান, ‘শ্রমিকদের বিক্ষোভের পর সব বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। তবে ভাঙচুরের কারণে মিল তিন দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকব।’

ভালুকার হাইওয়ে থানার ওসি মেহেদী হাসান বলেন, ‘সময়মতো বেতন দিলে এমন অবরোধ হতো না। মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষ আন্তরিক হলে জনগণের ভোগান্তি এড়ানো সম্ভব।’

ময়মনসিংহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কেউ নিজের স্বার্থে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে না। আমরা সবসময় জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় রাখি।’

শিল্প পুলিশ-৫-এর পুলিশ সুপার মো. ফরহাদ হোসেন খান বলেন, ‘ভালুকায় প্রায় ৩০০ কোম্পানি আছে। আমরা মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করি। তারা যেন মহাসড়কে না আসে, সে বিষয়ে সচেতন করি। প্রয়োজনে বারবার বসে সমাধান করব।’

ভালুকা সেনা ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর তাকিব বলেন, ‘শ্রমিকরা রাস্তায় নামলে বহু অ্যাম্বুলেন্স ও রোগী আটকে পড়ে। রাস্তা অবরোধ করা মানে মানুষের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া, এটা কেউ করার অধিকার রাখে না।’

ষড়যন্ত্র দেখছে বাস মালিক সমিতি: জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি আলমগীর মাহমুদ আলম মনে করেন, ‘শ্রমিক অবরোধের পেছনে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। নির্বাচনের আগে গার্মেন্টস খাতকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চলছে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রও এই অস্থিরতায় ভূমিকা রাখতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা রাখতে সচেষ্ট, গার্মেন্টস মালিকরাও যদি তেমন সজাগ থাকেন, তবে এ ধরনের অবরোধ কমে আসবে।’

ময়মনসিংহ বিভাগীয় কলকারখানা উপ-মহাপরিদর্শক আহমদ মাসুদ বলেন, ‘আমরা নিয়মিত কারখানায় পরিদর্শক পাঠাই, নোটিশ দিই এবং আইনগত পদক্ষেপ নিই। কেউ সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলতে পারে না। অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।’

তিনি জানান, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে বসে ওরিন গ্রুপসহ কয়েকটি কারখানার পাওনা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে।

মহাসড়ক অবরোধ এখন আর শুধু প্রতিবাদের ভাষা নয়, এটা এক অচল চক্রে আটকে যাওয়া সমাজের প্রতিচ্ছবি। দাবিদাররা হয়তো তাদের কথা জানানোর জায়গা খুঁজে পান না, কিন্তু তার মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ, নারী, শিশু, রোগী ও কর্মজীবী শ্রেণি।