** বরগুনার আমতলী
** স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, দুর্নীতির প্রশ্রয়ে তালিকা তৈরি
** আবেদন পূরণে রয়েছে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ
** উপজেলা প্রশাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস
বরগুনার আমতলীতে বরাদ্দকৃত ৬৫.৭০ টন খাদ্যের বিপরীতে এক হাজার একশ সত্তুর ভিজিডি (ভালনারেবল উইমেন বেনিফিশিয়ারি) উপকারভোগী কার্ডের জন্য যাচাই-বাছাই তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারের সেফটি নেটের আওতায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত দুস্থ ও অসহায় নারীরা। তাদের জায়গায় সুবিধা নিচ্ছেন বিত্তবান ও সচ্ছল পরিবারের সদস্যরা। ভিজিডি কর্মসূচি গ্রামীণ দুস্থ অসহায় নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য পরিচালিত একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। কর্মসূচির আওতায় নারীদের দুই বছর ধরে প্রতি মাসে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। তবে তালিকা প্রণয়নে অনিয়মের কারণে এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নে ৩৭২ জন, আঠারোগাছিয়া ৩০৪ জন, চাওড়া ২৭৮ জন, হলদিয়া ৩৮৮ জন, আমতলী সদর ৩২৬ জন, কুকুয়া ৩১৩ জন ও আড়পাঙ্গাশিয়া ১৮৮টি জন দুস্থ অসহায় নারী ভিজিডি কর্মসূচির সেবা নিতে আবেদন করে। এরমধ্যে অধিকাংশ ইউনিয়নে ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় সেবা নিতে উপকারভোগীদের কার্ডের চূড়ান্ত তালিকায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে প্রকৃত দুস্থদের এড়িয়ে সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট উপজেলার মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আবেদনপত্র পূরণের অজুহাতে জনপ্রতি তিনশ’ করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এই তালিকা তৈরির অভিযোগ উঠেছে। এমন অনিয়ম দুর্নীতির কারণে অনেক দুস্থ অসহায় এবং বিধবা নারী ভিজিডি কার্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আমতলীর বেশিরভাগ ইউনিয়নের প্রায় ওয়ার্ডেই উপকারভোগী নির্বাচন হয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির মধ্যদিয়ে। অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের কারণে কার্ডের তালিকায় বিত্তবানদের নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রকৃত অসহায় ও দরিদ্ররা দীর্ঘদিন ধরে ভিজিডি কার্ড থেকে বঞ্চিত হলেও অর্থ ও প্রভাব খাটিয়ে পছন্দের লোকজন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আমতলীর চাওড়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশিদ জানান, ‘আমাদের ইউনিয়নে ২৭৮টি পরিবারের জন্য ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান খান বাদল আমাদের ১২ জন সদস্যকে দশটি করে মোট ১২০টি পরিবারের তালিকা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আমার ওয়ার্ডে মাত্র দশটি পরিবারের নাম দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় পড়ে এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক। চেয়ারম্যান ১৫৮টি পরিবারের তালিকা নিজে করেছেন। উপকারভোগী যাচাই-বাছাই করেছেন চেয়ারম্যান ও উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা। তারা দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি করেছেন কি-না সে বিষয়টি আমাদের জানা নেই।’ একই ঘটনা ঘটেছে আমতলী উপজেলার সিংহভাগ ইউনিয়নেই।
চাওড়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের চন্দ্রা গ্রামের হতদরিদ্র মো. রুস্তম আলীর স্ত্রী আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমরা দিন আনি দিন খাই। পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতেছি। ভিজিডি কার্ড পাওয়ার জন্য আবেদনও করেছিলাম। টাকা দিতে পারিনি বিধায় কার্ড পাইনি। অথচ আমাদের চোখের সামনেই অনেক ধনবান ও সচ্ছল পরিবার কার্ড পেয়েছে। ‘একই ইউনিয়নের পাতাকাটা গ্রামের মো. আমিরুল ইসলামের স্ত্রী জাকিয়া বেগম জানান, আমরা নিতান্তই হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য। জমি জমা বলতে আমাদেরকে কিছুই নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরায় সবসময়। অথচ সরকারি চাল ও ভিজিডি কার্ড থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিডি কার্ড বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে হতদরিদ্র মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। অসচ্ছল এবং হতদরিদ্রদের বাছাই করে কার্ড বিতরণ করার কথা থাকলেও চেয়ারম্যান মেম্বাররা অর্থের বিনিময়ে সচ্ছল ও সম্পদশালীদের নামের তালিকা করেছেন। যারা টাকা দিতে পারেনি তাদের কার্ড হয়নি বলেও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য রোজিনা জানান, ভিজিডি কার্ড বাছাইয়ে চেয়ারম্যান সোহেলী পারভীন মালা নিজের মতো করে সব করেছেন। আমাদের প্রত্যেক সদস্যকে মোট আটটি করে পরিবারের তালিকা প্রদানের নির্দেশনা দেন। বাকি কার্ডগুলো তিনি নিজেই ইচ্ছামাফিক যাচাই-বাছাই করেছেন। এতে অনেক সচ্ছল-ধনী পরিবারেও তিনি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ভিজিডি কর্মসূচির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
গুলিশাখালী ইউনিয়নের জনৈক ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তালিকা তৈরির অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত হতদরিদ্র এবং অসহায়ের নতুন তালিকা করা জরুরি। প্রকৃত দুস্থ অসহায়দের নিয়ে নতুন করে তালিকা না করলে সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হবে। তিনি আরো বলেন, ভিজিডি কার্ড বাছাইয়ে আমাদের কোনো মতামত বা সুপারিশ নেওয়া হয়নি। মেম্বারদের ছাড়াই ট্যাগ অফিসার মহিলা অফিসের প্রতিনিধিরা বাছাইয়ের কাজ করেছে। মেম্বারদের অন্তর্ভুক্ত না করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভিজিডি তালিকা করেছেন।
আমতলী উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক কর্মকর্তা বলেন, ভিজিটি তালিকাভুক্তির সময় যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে। ইতোমধ্যেই তালিকাভুক্ত হতে পারেননি এমন অসংখ্য প্রকৃত অসহায় দুস্থ নারী আমাদের অফিসে এসেছেন। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় কেউ বাদ পড়লে সেখানে আমাদের কিছুই করণীয় নেই।
এ ব্যাপারে আমতলী মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রূপ কুমার পালের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।