প্রায় ১৭ শতকের শুরু থেকে ভারত হয়ে ওঠে বিশ্বে অন্যতম উচ্চ তামাক উৎপাদনকারী দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তামাক উৎপাদন করলেও, ভারতের তামাক উৎপাদন মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই ব্যবহৃত হতো। ফলে রপ্তানির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম।
যদিও তামাকের আদি জন্মভূমি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা হলেও, এর প্রভাব অল্প সময়েই ছড়িয়ে পড়ে উপমহাদেশজুড়ে। শুরুতে এটি ছিল অভিজাতদের বিলাসিতা, পরবর্তীতে তা হয়ে ওঠে বৃহৎ বাণিজ্যের অংশ। ঔপনিবেশিক আমলে তামাকের এই বিস্তার হয়ে উঠেছে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়।
১৫৯০ সালের আগেও ভারতে তামাক ছিল একেবারেই অপরিচিত। সম্রাট আকবরের আমলের প্রশাসনিক দলিল আইন-ই-আকবরিতে তামাকের কোনো উল্লেখই ছিল না।
তবে ১৬০৪-০৫ সালের দিকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে এর প্রথম উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব পাওয়া যায়। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই উদ্ভিদ, এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ধূমপানের প্রবণতা দেখা দেয়।
তামাকের বিস্তার ঠেকাতে সম্রাট জাহাঙ্গীর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তবুও এর জনপ্রিয়তা কমেনি। ব্রিটিশ ও পর্তুগিজদের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়ে গুজরাট ও অন্ধ্র প্রদেশে। মসুলিপটাম ও সুরাট হয়ে ওঠে প্রধান উৎপাদন ও রপ্তানি কেন্দ্র।
ব্রিটিশ পর্যবেক্ষক উইলিয়াম মেথওল্ড থেকে শুরু করে ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব, সকলেই তামাক চাষের বিস্তারের কথাই বলছেন। রাজা থেকে প্রজার বাড়ির পান খাওয়ার উপকরণেও জায়গা করে নেয় তামাক। উপহার হিসেবে উপস্থাপন হতো, এমন নজিরও রয়েছে।
১৬১২ সালে ব্রিটিশ রবার্ট ক্লার্কসন সুরাটে তামাক কারখানার দায়িত্ব পান- এটাই ব্রিটিশ নথিতে তামাকের প্রথম উল্লেখ। এরপর থেকে সুমাত্রা, জাভা, পারস্য, এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত ভারতীয় তামাক রপ্তানি হতে থাকে।
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নানা অঞ্চল- গুজরাট, অন্ধ্র প্রদেশ, বাংলা, বিহার, ওড়িশা- তামাক উৎপাদনের বড় কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৮৭০-এর দশকে বাংলা থেকে রপ্তানি আয় পৌঁছায় কয়েক কোটি রুপিতে। রংপুর, কুচবিহার, তিরহুত, মুঙ্গের, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চল হয়ে ওঠে তামাক চাষের ঘাঁটি।
ব্রিটিশ আমলে বাংলা তামাক রফতানির প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম ও কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে তা পৌঁছে যেত লন্ডন, ভেনিস, ফ্রান্স, হল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। রংপুরের উৎপাদিত তামাক ব্যবহৃত হতো বার্মায় চুরুট তৈরিতে।
তামাক ব্যবসার মধ্য দিয়ে বাংলায় গড়ে ওঠে নতুন এক মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি। উনিশ শতকে হাজি করম এলাহি ও তার ভাই বখশ এলাহির মতো উদ্যোক্তারা তামাক নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য। গওহর জানের মতো সংগীতশিল্পী দিয়ে প্রচার চালিয়ে ‘বখশ এলাহি অ্যান্ড কোং’ হয়ে ওঠে একচেটিয়া সিগারেট কোম্পানি।
ধূমপানের অভ্যাস ভারতীয় সমাজে শুধুই আনন্দ বা আসক্তির বিষয় ছিল না, বরং এক সময় তা হয়ে ওঠে সামাজিক রীতির অংশ। হুঁকা, পান ও সিগারেটের ভিন্নধর্মী ব্যবহার ধীরে ধীরে সকল শ্রেণিতে জনপ্রিয়তা পায়। অভিজাত থেকে নিম্নবিত্ত, সবাই তামাকে আসক্ত হতে থাকে।
ভারতের কৃষি ইতিহাসে তামাক চাষ এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। এটি শুধু নগদ অর্থের উৎসই নয়, কৃষকদের জীবনে আনে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হয়।