ঢাকা শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি ও বাস্তবতা

বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫, ১০:৪৫ এএম
ছবি- সংগৃহীত

জুলাই গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী রাষ্ট্র সংস্কারবিষয়ক আলোচনার মধ্যে অন্যতম বিষয় হয়ে ওঠে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতির প্রচলন। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ধারণা এমন একটি নির্বাচনি ব্যবস্থা, যেখানে সংসদে প্রার্থী বা সদস্য তার দলের মোট ভোটের অনুপাতে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে আগে থেকেই বিভিন্ন দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কথা বলে আসলেও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর এই দাবি জোরেশোরে উঠতে থাকে। বিশেষ করে, আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামী সোচ্চার হয়। অন্যদিকে বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেই অবস্থান করছে। দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকায় এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না; বরং বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই দাবিসহ আরও কিছু দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে আসে।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা বাস্তবায়নের জন্য যে রাষ্ট্রকাঠামো ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা বাস্তবায়নে যথেষ্ঠ সময় কি বাংলাদেশের হাতে আছে? বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সময় বাকি মাত্র পাঁচ মাসেরও কম। ফেব্রুয়ারিতেই ভোট করতে হলে হাতে থাকা সময়ের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে যাওয়ার বাস্তবতা আছে কি না- সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। এটা বাস্তবায়নের জন্য যে রাষ্ট্রকাঠামো ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেই অবকাঠামো কি বাংলাদেশের আছে বা নিকট ভবিষ্যতে কি সেটি আমরা অর্জন করতে পারব?

বাস্তবিক অর্থে বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক সংস্কার। আমরা যদি গত এক বছরের অধিক সময়ের রাষ্ট্র পরিচালনার দিকে তাকাই, তাহলে সংস্কার নিয়ে আমাদের খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো ইঙ্গিত মেলে না। আবার রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্য না এলে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা আমাদের জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে না। পাশাপাশি এ বিষয়ে দক্ষ জনবল প্রয়োজন, যা স্বল্প সময়ে তৈরি করাও অসম্ভব।

নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নে রয়েছে আইনগত, প্রশাসনিক ও জনসচেতনতার চ্যালেঞ্জ। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের যে লক্ষ্য, সেই সময়ের মধ্যে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

জেসমিন টুলি বলছেন, এমন বাস্তবতায় যদি এখন পিআর চালু করতেও হয়, বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ। প্রথমত সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনতে হবে। এই অনুচ্ছেদে সংসদ প্রতিষ্ঠার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর সেই সংশোধনের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করতে হবে। আইনের আলোকে বিধিমালা তৈরি করতে হবে। আর এই বিধিমালা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনবল।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে এফপিটিপি পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়ে আসছে। মাঠপর্যায়ে মানুষ এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। তারা নিজের এলাকার প্রার্থীকে ভোট দেয়। পিআর পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার ধরন ভিন্ন, তাই জনগণকে নতুনভাবে বোঝাতে হবে। পিআর পদ্ধতির ধরন, ক্যান্ডিডেট নির্বাচন, ভোট গণনা—সবকিছু ভোটারদের ‘বুঝিয়ে বলার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা কর্মসূচি’। সব মিলিয়ে যে সিস্টেমটা তৈরি করতে হবে সেটা বছর দেড়েকের আগে শেষ করা সম্ভব হবে না। সুতরাং ফেব্রুয়ারির মধ্যে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন ‘কোনোভাবেই সম্ভব নয়’।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, আরপিওতে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) পিআর নেই এবং আরপিও সামনে রেখেই কমিশনকে এগোতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার অবশ্য সময়ের প্রতিবন্ধকতা মানতে নারাজ। তিনি একটি গণমাধ্যমের কাছে বলেন, ‘‘যদি রাজনৈতিক দলগুলো পিআর পদ্ধতির দাবিতে একমত হয়, তাহলে এটি বাস্তবায়ন করা ‘ম্যাটার অব ওয়ান মান্থ (এক মাসের ব্যাপার)’’ ।

সিইসির বক্তব্যকে ‘একপেশে’ মন্তব্য করে তিনি একটি গণমাধ্যমকে বলেন, সংবিধান, আরপিও সবই সংশোধনযোগ্য। ঐকমত্য কমিশনের পথ রুদ্ধ হয়নি, সরকার চাইলে আমাদের আলোচনায় ডাকতে পারে। তার মতে, আন্দোলন, গোলটেবিল, পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে সংবাদ এবং লেখালেখির মাধ্যমে জনগণ সচেতন হচ্ছে। জাতি ম্যাচিওরড্ হচ্ছে, লারনেড হচ্ছে। এই আন্দোলন রাজনীতিরই অংশ, যোগ করেন মিয়া গোলাম পরওয়ার।