ঢাকা সোমবার, ২৬ মে, ২০২৫

জুনের পরে নির্বাচন নয় পদত্যাগপত্রে লিখে দেবেন ড. ইউনূস

এফ এ শাহেদ 
প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৫, ০৩:৩৭ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ১১টি রাজনৈতিক দলের ১১ জন নেতা। আলোচনা শেষে তারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূসের যোগাযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা নিশ্চিত করেছেন, জুনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

রোববার (২৫ মে) বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে সরকারপ্রধানের বাসভবন যমুনায় এ বৈঠক শুরু হয়। প্রথম দফায় ১১ জনের সঙ্গে বৈঠকের পর দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন রাজনীতিকসহ আরও ৯ ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয় দফার বৈঠকে হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, ‘ডিসেম্বর থেকে জুন লম্বা সময়, সে ক্ষেত্রে সরকারের কাছে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় চেয়েছি আমরা।’
 
প্রথম দফার বৈঠক শেষে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা খুবই হতাশ হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এত দিন ধরে যে উদ্দেশ্যে কাজ করেছেন, তার কিছুই সফল করা সম্ভব হবে না। সুষ্ঠু সংস্কার, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনসহ যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, কোনো কিছুই সম্পন্ন করতে পারবেন না। সেই চরম হতাশার জায়গা থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এমনকি তিনি পদত্যাগপত্রও লিখেছিলেন, যা জমা দিতে বাধা দিয়েছেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বা রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই চাইনা এভাবে বিদায় নেবেন ড. ইউনূস। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছি। একই সঙ্গে নির্বাচন কবে এবং কীভাবে অনুষ্ঠিত করতে চান, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছি।’ মাহমুদুর রহমান বলেন, প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, কম সংস্কার হলে ডিসেম্বরেই নির্বাচন সম্ভব। আর বেশি সংস্কার চাইলে জুনের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। জুনের বাইরে জাতীয় নির্বাচন কোনোভাবেই যাওয়ার সুযোগ নেই বলে নিশ্চিত করেছেন ড. ইউনূস। প্রয়োজন মনে করলে প্রধান উপদেষ্টা তার পদত্যাগপত্রে জুনের বাইরে নির্বাচন নয় এ বিষয় লিখে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
  
তিনি আরও বলেন, জুনের পরে কোনোভাবেই নির্বাচন গড়াবে না। তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, যারা সন্দেহ করেন নির্বাচন জুনের পরে গড়াবে, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, অবশ্যই নির্বাচন জুনের মধ্যে হবে। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, সেটি করেই নির্বাচন দিতে।
   
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, সবার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে আগামী বছরের ৫ ফ্রেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনটা করা যায় কি না, তা ভেবে দেখতে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের ঐক্য ধরে রাখা যায়নি। উপদেষ্টা পরিষদের কেউ কেউ এর জন্য দায়ী। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের ব্যাপক সন্দেহ, সংশয়, গ্যাপ ও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। নবগঠিত দল এনসিপির সঙ্গেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে।
 
তিনি আরও বলেন, সরকারের কর্তৃত্ব ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া রাষ্ট্র শাসন করা অসম্ভব একটি ব্যাপার। মনে হচ্ছে, সিভিল ও সামরিক প্রশাসনের ওপর সরকারের এখনো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যা উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে আরও স্পষ্ট হয়েছে। আমরা মনে করি, গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর পরস্পর স্বার্থকেন্দ্রিক অনৈক্য, মতাদর্শগত বিরোধ, পারস্পরিক বাকবিতণ্ডা এবং ব্লেমগেমও সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয় সমাধানে সরকারের বিশেষ কোনো চেষ্টা বা আন্তরিক উদ্যোগ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও এসব বিষয়কে আরও জটিল করে তুলেছেন। এমতাবস্থায় শুধু আহ্বান, আনুষ্ঠানিক বৈঠক বা আশা পোষণ ও জাতীয় বিবৃতি দিয়ে এই সংকটের সমাধান হবে না। কাদা ছোড়াছুড়ি ও পরস্পর দোষারোপ পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলবে। তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি, বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সঠিক উপলব্ধি, ছাড় দেওয়ার মনোভাব প্রদর্শন, ইগো পরিত্যাগ ও সমঝোতামূলক পদক্ষেপই উত্তম সমাধান। সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব গ্যাপ ও ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে, তা সংশোধনে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন, সংশোধন, পরিমার্জনসহ জাতীয় ঐক্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে কঠোর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। নির্বাচন, সংস্কার ও ফ্যাসিবাদী-খুনিদের বিচারের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।

প্রথম দফার বৈঠকে তিনটি বামপন্থি দলসহ ১১টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা যোগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ (বীর বিক্রম), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাবেক আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।

দ্বিতীয় দফার বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘জুলাইয়ের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ফলে জাতির সামনে রাষ্ট্রের নীতিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, কোনোভাবেই সেই সুযোগ নষ্ট করা যাবে না। সবার ঐক্য ধরে রাখতে হবে। যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটি করেই জাতীয় নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়েছি।’ 

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেছি। ডিসেম্বর থেকে জুন লম্বা সময়। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় চেয়েছি। তবে, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন, জুনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। চলমান যে সংস্কার প্রক্রিয়া, তার কাঙ্ক্ষিত কোনো অর্জন আমরা দেখতে পাইনি, সে বিষয়ে উদ্দেগের কথা আমরা জানিয়েছি। অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে না গিয়ে সরকার কতটুকু সংস্কার করছে এবং কতটুকু করতে চায়, তা জানতে চেয়েছি। শাপলা চত্বরে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল, তার সঙ্গে জড়িত সবার দৃশ্যমান ফলাফল দাবি করেছি, যেটির আশা দিয়েছে সরকার। তিনি আরও বলেন, করিডর ও বন্দর ইস্যুতে জনগণের স্বর্থবিরোধী কোনো কাজ অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বারা হবে না। 

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন রাজনীতিকসহ আরও ৯ ব্যক্তিত্ব, যাদের মধ্যে ছিলেন ইসলামী বক্তা মাওলানা সাদিকুর রহমান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা আহমেদ আব্দুল কাদের, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার, ইসলামী ঐক্যজোটের  মহাসচিব মুফতি মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাযী।

এর আগে শনিবার (২৪ মে) সন্ধ্যায় যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধিদল বৈঠক করে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে এসব বৈঠক অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।