নাটোরের বিস্ময়কর গ্রাম হুলহুলিয়া। মডেল ও স্মার্ট ভিলেজ হুলহুলিয়া ঘুরে আসার মধ্য দিয়ে আরেকটি অপূর্ণ ভ্রমণ তৃষ্ণা শেষ পর্যন্ত পূরণ হল।
অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় এই গ্রামের কথা আমি প্রথম যেদিন শুনেছিলাম সেদিনই ঠিক করে ফেলেছিলাম আমি এই গ্রামে একবার যাবই। আমাদের বিয়ের পরে জেনেছি আমার স্ত্রীর ফুফাতো বোন রেনু আপার বিয়ে হয়েছে ঐ গ্রামে। হুলহুলিয়া গ্রাম দেখার সুবাদে রেনু আপা ও দুলাভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়া হবে।
যাত্রা শুরু
আমাদের পরিকল্পনা ছিল কোন এক শনিবার ছুটির দিনে হুলহুলিয়া গ্রামে যাব। সেই মতে বাউয়েটের অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মোঃ সেলিম রেজা, এডমিশন সহকারি ইনফরমেশন অফিসার মোঃ নাজমুল ইসলাম উজ্জ্বল ও তার বন্ধু ঈশ্বরদী মহিলা কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক তনয় বের হয়ে পড়লাম।
বনপাড়া থেকে তিরাইল মৌখাড়া, নাজিরপুর হয়ে সোজা বিলদহর বাজার। বিল বিলদহরের বৈকালিক মাছের বাজারটা ঘুরে দেখার একটু দেখার ইচ্ছা ছিল। সেটাও পূরণ হল মাছ বাজারে গিয়ে। সিংড়ার চলনবিলের তরতাজা বোয়াল, সোল, চিতল, শিং মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ দেখলাম। তবে কেনা হলো না।
এরপরে রওনা হয়ে গেলাম আত্রাই নদী এবং গুড়নাই নদীর মিলিতস্থল ত্রিমোহনি। ভৌগোলিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় দোয়াব আর স্থানীয়ভাবে বলে ত্রিমোহনি। ত্রিমোহনী ব্রিজে কিছু সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি। কয়েকজন স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল ত্রিমোহনীতে সুতি জালের মাধ্যমে প্রচুর মাছ ধরা হয়।
স্থানীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে মাঝে মধ্যে সংঘর্ষ হয় আবার মিটে যায়। ত্রিমোহনী থেকে নূরপুর বাজার হয়ে সিংড়া বাসস্ট্যান্ড বাজারে খাওয়া বিরতি। একটি হোটেলে দুপুরের খাওয়া খেয়ে রওনা হয়ে যাই হুলহুলিয়ার উদ্দেশ্যে।
অবস্থান
নাটোরের সিংড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে চৌগ্রামের পশ্চিমে শান্তিময় এক গ্রাম হুলহুলিয়া। হুলহুলিয়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ল হুলহুলিয়া শতভাগ শিক্ষিত মডেল ও স্মার্ট ভিলেজ গেইট। গেইট পার হয়ে বাম পাশে নজরে আসলো হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ ভবন। বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। সন্ধ্যা হয়ে আসার কারণে বেশি দেরি না করে মূল গ্রামের ভেতর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত হলো।
আমরা সন্ধ্যার আগে গিয়ে পৌঁছলাম হুলহুলিয়া গ্রামের হুলহুলিয়া স্কুলের সামনে। বসা পেলাম মধ্যবয়সী এবং প্রৌঢ় কয়েকজন মুরুব্বী। আমাদেরকে যেতে দেখেই তারা খোঁজ খবর নিলেন- পরিচয় হলো মির্জা পরিবারের মির্জা হান্নান সাহেবের সাথে। মির্জা পরিবারের সন্তান প্রফেসর ড. মির্জা আফম রশিদুল হাসান হেলাল স্যারের চাচা তিনি। হেলাল স্যার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং তার স্ত্রী প্রফেসর ড. রুবাইয়াত ইয়াসমিন একই বিভাগের স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় শিক্ষক।
বাউয়েট প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তারা দুজন খন্ডকালীন শিক্ষক এবং দুইটি বিভাগের বিভাগীয় ধানের দায়িত্ব পালন করেন। প্রফেসর ড. মির্জা আ ফ ম রশিদুল হাসান হেলাল স্যার সিএসই এবং প্রফেসর ড. রুবাইয়াত ইয়াসমিন সেবা আইসিই বিভাগের প্রধান ছিলেন। তাদের দায়িত্ব পালনকালে বিভাগের উন্নয়ন ও সুনামের জন্য আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করেছেন তারা যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আগেই বলেছিলাম রেনু আপার বিয়ে হয়েছে হুলহুলিয়া গ্রামে।
দুলাভাই সাব রেজিস্টার ঢাকাতেই অবস্থান তবুও খুঁজে বের করলাম রেনু আপার বাসা। বাসায় কেউ নেই শুধু তালামারা থাকে গেইট। দুই ঈদে আসে ঘরবাড়ি ঝাড়ফুঁক করে ঈদ কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে যায়। যার ফলে তাদের কারো সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবুও খুঁজে বের করেছি তাদের বাসা। বাসার দক্ষিণে বিশাল বড় দিঘি। শান বাধা দিঘির পাড়ে কিছু সময় কাটিয়ে চলে আসি হাইস্কুলের সামনে।
ইতোমধ্যে খবর হয়ে গেল গ্রামে মেহমান এসেছে। আমরা মাগরিব নামাজ পড়লাম হুলহুলিয়া হাইস্কুল সংলগ্ন মসজিদে। নামাজ পড়ে গ্রাম থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি কিন্তু বাধ সাধলেন হুলহুলিয়া গ্রামের সমাজ উন্নয়ন এর বর্তমান সভাপতি মো. আমিনুর রহমান। তার সাথে সাক্ষাত করে তবেই যাওয়ার অনুমোতি মিলবে। তিনি দাওয়াত করলেন সমাজ উন্নয়ন পরিষদে ভবনে যাওয়ার জন্য সেখানে তিনি সংক্ষেপে আমাদের সাথে মতবিনিময় করে কিছু তথ্য প্রদান করবেন।
শেষ রক্ষা হয়নি
আমরা সেখানে গিয়ে তাদের সাথে মতবিনিময় করতেই হেলাল স্যারের চাচা জানালেন আপনাদেরকে কিছু নাস্তা না করে আপনাদেরকে যেতে দেওয়া হবেনা হেলাল স্যারের নির্দেশ। তিনি ফোন করে বললেন ‘আপনি এবং আপনার টিম অবশ্যই আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে পদধূলি দিয়ে যাবেন।’ পড়ে গেলাম আরেক বিপদের মধ্যে।
স্যার নিজেও বাসায় নেই উনার মেজো ভাই (বেলাল ভাই) জরুরি পারিবারিক কাজে নন্দীগ্রাম গিয়েছেন। আমাদের আসার খবর পেয়ে তিনি তড়িঘড়ি করে থেকে চলে আসেন। আয়োজন করেছেন বিভিন্ন রকমের নাস্তার। অনেকটা এমন যেন পড়েছো মোঘলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে।’ অগত্যা আমি হান্নান চাচার সাথে গিয়ে হাজির হলাম মির্জা হেলাল স্যারের বাসায়।
বৈঠকখানার উপরে নজর পড়তেই দেখলাম বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বাউয়েট) এর ভর্তির ব্যানার। দেখে মনে হলো অনেকদিন যাবত ঝোলানো হয়েছে। কিন্তু কেন? পরে মনে হলো নাটোরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন নাটোরবাসী প্রফেসরের আন্তরিকতার একটা খন্ড চিত্র এটা। তাদের দুজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা দুটোই আমরা দেখতে পেয়েছি এখানে এসে।
ফিরে দেখা
১৯৪০ সালে এই গ্রামে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে একটি সংগঠন কাজ শুরু করে গ্রামের মানুষদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থেকে শুরু করে ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা ও সবরকম সামাজিক সমস্যার সমাধানে কাজ করে আসছে সংগঠনটি। হুলহুলিয়া গ্রাম ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত।
এই গ্রামের আয়তন প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার দেশের আর আট দশটা গ্রাম থেকে এখানকার চিত্র একদমই আলাদা যেখানে শিক্ষার হার শতভাগ স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এই গ্রামের কেউ খুব একটা মামলা মোকদ্দমায় জড়ায়নি। যেখানে বাল্যবিবাহ যৌতুক ও মাদকের মতো সামাজিক সমস্যা নেই। এই গ্রামের প্রতিভাবান সন্তানদের মধ্যে রয়েছেন সহস্রাধিক প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও আইনবিদসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধি।
নির্বাচন পদ্ধতি
গ্রাম পরিচালনা করার জন্য দুই বছর পরপর গ্রামবাসীদের ভোটের মাধ্যমে হুলুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের ২৩ জন সদস্য নির্বাচিত হন । সদস্যের মধ্যে একজন থাকেন চেয়ারম্যান আর একজন ভাইস চেয়ারম্যান আর বাকি ২১ জন সদস্য হিসেবে থাকেন। এই বিচারক প্যানেলের মাধ্যমে বিচার করা হয় গ্রামবাসীদের ছোট ছোট অপরাধ এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে নিজস্ব ঝামেলা বা জমি নিয়ে বিরোধ গ্রামের মিটিয়ে ফেলা হয়। যার ফলে গ্রামবাসীদের আদালতে যাবার প্রয়োজন পড়ে না।
এই গ্রামে গত ১০০ বছরে কোন পুলিশ আসেনি এবং আসার প্রয়োজন হয়নি। এটা অত্যন্ত অসাধারণ একটা বিষয় কারণ বাংলাদেশে এরকম গ্রাম খুঁজে পাওয়া কিন্তু দুষ্কর যে গ্রামে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোন পুলিশ প্রবেশ করেনি। এই গ্রামে অরাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে একটি হচ্ছে শিকড় আরেকটি হচ্ছে বটবৃক্ষ। এই দুটি সংগঠনের সদস্যরা এই গ্রামের অভাবী, গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার খরচ বহন করে। বাংলাদেশের সব গ্রাম যদি এমন হতো তাহলে বাংলাদেশের চিত্র পুরোটাই পাল্টে যেত।
সভাপতি মোঃ আমিনুর রহমান গ্রাম আদালত চত্বরে মতবিনিময়ের পরে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের ভবনটির ঘুরে দেখান । নিচ তলায় বেশ কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তিদের পোস্টার এবং সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হয়েছে। উপরের তলায় বিবাহ আয়োজনের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের জন্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। অতিথিদের রাত্রিযাপনের জন্য সুব্যবস্থা রয়েছে।
এবার বিদায়ের পালা
যেতে নাহি দিব হায় তবু যেতে দিতে হয়। এশার আযানের পর সবার কাছ থেকে আমরা বিদায় নিয়ে চৌগ্রাম বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে সিংড়া বাসস্ট্যান্ডে এসে যাত্রা বিরতি। রাস্তার পাশে বেশ কিছু ফাস্টফুড আইটেম বিক্রি করছে কয়েকজন উঠতি বয়সি তরুণ যুবক। গরম গরম পরোটা ডিম আলু ভাজি। প্রথমে খাব কি খাব না ভাবতে ভাবতে শুরু করা হলো।
বেশ ভালো লাগলো গরম পরোটা নাস্তা পর্ব শেষ করে আবার যাত্রা শুরু অবশেষে বনপাড়া নির্ধারিত সময়ের আগে পৌঁছে গেলাম বাসায়। আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে দয়ারামপুরের উদ্দেশ্যে উজ্জ্বল এবং তার টিম রওনা হয়ে গেল নতুন কোন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে।
আপনার মতামত লিখুন :