বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারকে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন জেলার মোহাম্মদ জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে দলীয় সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা কারাগারে কম্বল বাণিজ্য, ওয়ার্ড বাণিজ্য ও সিট বাণিজ্য করে প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা অবৈধ রোজগার করছেন।
পাশাপাশি ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় কারাবন্দি আওয়ামী লীগ নেতাদের স্মার্টফোন ব্যবহার করার সুবিধা দেওয়াসহ কাররক্ষীদের দিয়ে মাদক সরবরাহ করেও মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অপকর্ম প্রকাশ্যে আসতেই তদন্ত শুরু করেছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। ইতিমধ্যে শাস্তিস্বরূপ ১৫ কয়েদিকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তরসহ ৩ কারারক্ষীকে বদলি করা হয়েছে, যা নিয়ে বরিশালের প্রশাসনিক মহলের অন্দরে তোলপাড় চলছে। বিষয়টি কারাগারে দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
কারাগারের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর মোহাম্মদ জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে যোগ দেন। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামালের সুপারিশে তাকে বরিশালে পাঠানো হয়। বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে যোগ দেওয়ার পরেই তিনি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে কারাগারে বন্দিদের খাবার আত্মসাৎ, কম্বল বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য এবং ওয়ার্ড বাণিজ্যসহ কয়েকজন কয়েদিকে দিয়ে মাদকের ব্যবসাও শুরু করেন তিনি।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এই জেলার অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে একাধিক কারারক্ষী হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কেউ তার এই অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুললে তাকে সর্বপ্রধান কারারক্ষী বশির আহম্মেদ চাকরিচ্যুত করাসহ নানা ভয়ভীতি দেখাতেন। জেলারের অনৈতিক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করাসহ সব বাণিজ্য সম্পাদন করেন এই বশিরসহ ১৫-২০ জন কারারক্ষীর একটি গ্রুপ।
বশির তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগসমূহ অস্বীকার করলেও কারাগারের সূত্র জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় যারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, তাদের অধিকাংশের হাতেই স্মার্ট ফোন দেখা যায়।
জেলারের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রুপপ্রধান বশিরসহ গ্রুপের অন্যরা বরিশাল সদর আসনের সাবেক এমপি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম, বরিশাল সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু এবং গৌরনদী পৌসভার সাবেক মেয়র মো. হারিছুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে স্মার্ট ফোন পৌঁছে দেন। স্মার্টফোন ব্যবহার করে আসামিরা সার্বক্ষণিক ভিডিও কলে কথাও বলেছেন। বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতাদেরও অর্থের বিনিময়ে একই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন অনুসন্ধানী সূত্রগুলো একই তথ্য দিয়ে জানিয়েছে, জেলার জয়নাল আবেদিন কারারক্ষীদের পাশাপাশি কজন কয়েদিকেও কারাগারে মাদক বাণিজ্যে ব্যবহার করেছেন। নয়ন ও রূপন নামের দুই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে গাঁজা, ইয়াবা এবং ফেনসিডিল সরবরাহ করে থাকেন। বিষয়টি জানাজানি হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলী হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত রূপনকে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। একই অভিযোগে আরও ১৪ জনকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।
গত দুই দিনে জামিনে মুক্ত হয়েছেন এমন ১০ জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় রূপালী বাংলাদেশের এই প্রতিবেদকের। তারা সবাই প্রায় একই তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, কারাগারে অবাধে ঢুকছে ইয়াবা, গাঁজা এবং ফেনসিডিলসহ সব মাদকদ্রব্য। জেলারের নির্দেশনার আলোকে ওই মাদক নির্ধারিত ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে যায়। কারাগারের ভেতরে মাদক সরবরাহের কাজে রক্ষীপ্রধান বশির ছাড়াও কাজ করেন রনি ও মতিয়ার রহমান। প্রতিদিন তারা সাদা পোশাকে মাদক সরবরাহ করেন। চড়া দামে বিক্রি করা এই মাদকের টাকার একটি বড় অংশ যাচ্ছে জেলারের পকেটে।
এ ছাড়া কম্বল বাণিজ্য করেও প্রতিদিন মোটা অঙ্কের টাকা আয় করছেন জেলার জয়নাল আবেদিন। নিয়ম অনুযায়ী একজন বন্দি বিশ্রামের জন্য তিনটি করে কম্বল পেলেও আওয়ামী লীগ নেতারা অর্থের বিনিময়ে প্রতিজন ১০-১২টি করে ব্যবহার করছেন। পাশাপাশি তারা বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিন রান্না করা খাবারও কারাগারে নিয়ে আসছেন। কারাগারের ক্যান্টিন ম্যানেজার জুয়েল এবং সাব্বির জেলারের নির্দেশনায় প্রতিদিন সাইদুর রহমান রিন্টু এবং হারিছুর রহমানকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করে থাকেন।
বন্দিদের খাবারের অর্থ অত্মসাৎ করার অভিযোগও রয়েছে জেলারের বিরুদ্ধে। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া জনৈক ব্যক্তির অভিযোগ, ঠিকাদারের সাথে জেলার চুক্তি করে গত রমজান মাসে ইফতারিতে বাঁধাকপির পিয়াজু, পচা কলা ও নিন্মমানের খেজুর সরবরাহ করে। এ নিয়ে বন্দিদের মাঝে তখন চরম ক্ষোভ তৈরি হয়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে জেলারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি গাড়িতে আছেন, ঢাকা যাচ্ছেন বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। গতকাল শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে তার সঙ্গে কথা শেষ করার পরে বরিশালের দুজন স্থানীয় সাংবাদিক এই প্রতিবেদককে ফোন করে সংবাদটি প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান এবং আর্থিক সমাঝোতার প্রস্তাব দেন।
সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, জেলার জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া অপকর্ম নতুন নয়, তিনি তার আগের কর্মস্থল মৌলভীবাজার কারাগারকেও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিলেন। সেখান থেকেই ২০২৩ সালে তাকে বরিশাল কারাগারে বদলি করা হয়।
বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, জেলার জয়নাল আবেদিন আমদানি ওয়ার্ড থেকে মাসে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। কয়েদি ব্যাটারি জাকির আমদানি ওয়ার্ডে (সিডর ০৯) রাজার হালে থাকার সুযোগ করে দিয়ে বন্দিদের কাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেন, যার একটি অংশ পেয়ে থাকেন জেলার।
এ ছাড়া কারারক্ষী বদলিতেও ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে জয়নাল আবেদিনের বিরুদ্ধে। পছন্দের পদে কারারক্ষী নিয়োগ করেও তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ডিআইজি প্রিজনের নির্দেশনাও উপেক্ষা করেছেন। ডিআইজি প্রিজন প্রতি তিন মাস অন্তর কারারক্ষী বদলির সিদ্ধান্ত দিলেও অনেককে স্থানান্তর না করে অর্থের বিনিময়ে স্বপদে বহাল রেখেছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কারারক্ষী শফিকুল ইসলাম তিন মাস মেডিকেল ইনচার্জ থাকলেও তার কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে ফের তাকে ডাক্তারের ওয়ার্ডালি করেছেন জেলার। কারারক্ষী আরিফুর রহমান তিন মাস কারাগারের ভেতরের ক্যান্টিনে দায়িত্ব পালন করলেও তাকেই ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অস্ত্রাগার ও গোলাবারুদের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে। অথচ যোগ্যতা থাকার পরেও সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারারক্ষী জুয়েল গাজী ঘুষ না দিতে পারায় তাকে বিশেষ কোনো স্থানে রাখা হয়নি।
জেলারের এসব অপকর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে চাপে রয়েছেন ১০-১২ জন কারারক্ষী। তাদের অভিযোগ, অবৈধপথে অর্থ আয় করতে গিয়ে জেলার জয়নাল আবেদিন পুরোপুরি অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছেন। এমনকি তিনি কারাগারের মসজিদের উন্নয়নের অর্থও পকেটে ভরছেন। কারা বাগানের সবজি রান্না করে বন্দিদের খাইয়ে তাদের জন্য বরাদ্দে অর্থ আত্মসাৎ করাসহ সরকারি গাছ কেটে নিজের আসবাবপত্র বানিয়েছেন।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এই জেলার কারাগারের ভেতরে পিরোজপুরের এক প্রভাবশালী নেতাকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে মুঠোফোন এবং মাদকদ্রব্য সরবরাহ করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ডিআইজি প্রিজনের নির্দেশে ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে রাজধানী ঢাকার কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, জেলার জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ জেলা প্রশাসনের নজরে এসেছে, যা জেলা প্রশাসক দোলোয়ার হোসেনের নির্দেশে তদন্ত করছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুফল চন্দ্র গোলদার।
এই বিষয়ে জানতে কারা উপ-মহাপরিদর্শক মো. আলতাব হোসেন এবং জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেনের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তারা তা রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুফল চন্দ্র গোলদার জানিয়েছেন, অভিযোগ পাওয়ার পর সরেজমিনে তদন্ত করে বেশ কিছু আলামত পাওয়া গেছে। অনৈতিক বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে ১৫ কয়েদি স্থানান্তরসহ ৩ কারারক্ষীকে বদলি করা হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ না করে বিস্তারিত তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন এই কর্মকর্তা।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, কারাগারের ভেতর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মোবাইল ব্যবহারের সুবিধা দেওয়াসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসার আগেই জেলার জয়নাল আবেদিনকে চাঁদপুর কারাগারে বদলি করা হয়। তবে তিনি এই বদলি ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছেন এবং কীভাবে সবাইকে ম্যানেজ করে বরিশালে থাকা যায়, সেই ফন্দিফিকির করছেন।
এত অপকর্মের পরেও আওয়ামী লীগের এই দোসরের চাকরিতে বহাল থাকা নিয়ে খোদ আইন বিশেষজ্ঞদেরও নানা প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয় সেটাই দেখার বিষয়।