চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছোট হচ্ছে। ছোট হবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও। কিন্তু প্রতি অর্থবছরে আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত মানতে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হতে পারে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা।
যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ২৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা আর সংশোধিত লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, আগামী বাজেটের প্রস্তাবনা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুমোদনের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আজ শনিবার যমুনায় যাবেন। সব কিছু ঠিক থাকলে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের পর অর্থ বিভাগ অন্যান্য কাজ চালিয়ে যাবে। তবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে বাজেট উপস্থাপনের পর প্রয়োজনে কিছু হেরফের হতে পারে। জুলাই আন্দোলনের চেতনা, শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রতিফলন আগামী বাজেটে থাকবে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার। যা দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘটতে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উন্নয়ন ব্যয় চলতি বছর প্রস্তাব করা হয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধন করে করা হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করতে যাচ্ছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছর ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সরকার এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আর সংশোধন করে করা হয়েছে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়কর থেকে ১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ হতে যাচ্ছে। যা চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধন করে করা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। কাস্টম শুল্ক থেকে আদায়ের লক্ষ্য হতে যাচ্ছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
যা চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত ছিল ৫৩ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা আর সংশোধন করে করা হয়েছে ৫২ হাজার ৯২৫ কোটি টাক। ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক থেকে আদায়ের লক্ষ্য হতে যাচ্ছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৪৭ হাজার ৬১ কোটি টাকা, যা সংশোধন করে করা হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ১০ কোটি টাকা। এবং অন্যান্য এনবিআর কর আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হতে যাচ্ছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবে ছিল ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত করে করা হয়েছে ২ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া এনবিআর-বহিভর্‚ত রাজস্ব আদায় লক্ষ্য ১৯ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছর আছে ১৫ হাজার কোটি, যা সংশোধন করে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এনবিআর চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছে প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ৫১ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় খুব বেশি বৃদ্ধি না পাওয়ায় বেকাদায় রয়েছে সরকার।
এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই অঙ্কটাও বাস্তবভিত্তিক না। মূলত একটা কাল্পনিক সংখ্যার সাথে আরেকটা কাল্পনিক সংখ্যাকে তুলনা করা হতে যাচ্ছে। আর কোনো সরকারই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কিন্তু প্রতি অর্থবছরই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। এই সরকারের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
জানা গেছে, প্রতি অর্থবছরই রাজনৈতিক সরকারের সময় যেসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়, তা আগামী অর্থবছরের বাজেটে পরিহার করবে আন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমিয়ে আনতে সরকার বাজেট বাস্তবভিত্তিক করতে চায়। মূলত যে করেই হোক, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে যাবে। বিপরীতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা ও পরিমাণ বাড়ানো হবে, যাতে মানুষের কষ্ট কম হয়। কিন্তু আইএমএফের চাপে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কষ্টসাধ্য হবে। ফলে মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়তে পারে।
টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে যে পদ্ধতি ঠিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সেটি ‘ক্রলিং পেগ’ নামে পরিচিত। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতি ডলারের বিপরীতে বর্তমানে ১১৯ টাকা দামের সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়তে ও কমতে পারে। এর ফলে ডলারের দাম এখন সর্বোচ্চ ১২৩ টাকার মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন ডলারের দাম এখন যে পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হচ্ছে, ভবিষ্যতেও সেভাবেই হবে। তবে বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে দাম আরও বেশি হ্রাস-বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে।
আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করতে পারে ৬.৫ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরও ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫.৫ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছর আছে ৬.৮ শতাংশ। মূলত আগামী বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৩ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেট ঘাটতি ধরা হতে পারে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ।
জাহিদ হোসেন বলেন, এদিকে ঘাটতি গত বছরের তুলনায় জিডিপি অনুপাতে কমলেও টাকার অঙ্কে চিত্রটা অন্যরকম হবে। ফলে বিদেশি উৎস থেকে যা পাওয়া যাবে তা-ও খুব একটা সুখকর না। ফলে ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থার ওপরই বেশি নির্ভর করতে হবে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অন্য সরকারের বাজেটের মতোই নেতিবাচক ধারায় থাকবে। ফলে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ খুব একটা থাকবে না। আর বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ কম হলে ডলারের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, কমবে না।
তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে আগের কোনো সরকারই টার্গেট বাস্তবায়ন করতে পারিনি। চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৪.৫-এর বেশি হবে না। আবার আগামী অর্থবছরের বাজেটে যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৫ ধরা হয়, তাহলে প্রবৃদ্ধি ১০০ বেসিস পয়েন্ট বাড়বে। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে ২০০ বেসিস পয়েন্ট কমাতে হবে। যা কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিক থেকে বাজেটে রাজস্ব বৃদ্ধির চাপ রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার ৮ শতাংশের কম। দেশে ডলার-সংকট দেখা দিলে ২০২২ সালে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের আবেদনে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ।
ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলে দিয়েছিল, বাংলাদেশকে রাজস্ব-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার সময় আইএমএফের এই শর্তের কথাও বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান।
আপনার মতামত লিখুন :