জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে এসেছে পট পরিবর্তন। প্রাণ বাঁচাতে লাপাত্তা আওয়ামী লীগ নেতারা। ব্যতিক্রম শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও কর্ণফুলী নদীতে থাকা জাহাজ থেকে তেল চোর সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের প্রধান আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস শুক্কুর এখনো বীরদর্পে করছেন তেল চুরি। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের মদদে চলত তার এই অনৈতিক কর্মকাণ্ড।
এবার কৌশল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি, জাহাজের নাবিক ও ডিপোর অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় থানা পুলিশ ম্যানেজ করে বহির্নোঙরে থাকা বিদেশি জাহাজ থেকে প্রতিদিনই চুরি করছেন হাজার হাজার লিটার তেল। তেল চুরির জন্য তার নামই হয়ে গেছে ‘তেল শুক্কুর’।
দেশের জ্বালানি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র চট্টগ্রামের পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল ডিপোতে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে স¤প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনেও। কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার জন্য কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনও।
সূত্র মতে, দেশের জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা এসব তেল নিয়ে প্রতি মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে দেশি-বিদেশি অনেক জাহাজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসার সময় এসব জাহাজ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তেল নিয়ে আসে। এসব তেল চট্টগ্রামে এনে স্থানীয় চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করা হয়। এতে কোনো শুল্কও পরিশোধ করতে হয় না। তাই তুলনামূলক সস্তায় তেল কিনতে পারে চোরাকারবারিরা। পরে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প কিংবা স্থানীয় লাইটারেজ জাহাজগুলোতে বিক্রি করা হয় এসব তেল। কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ থাকায় সংঘবদ্ধ চক্র বাজারদরের চেয়ে কম দামে তেল বিক্রি করে থাকে।
এই তেল চোর সিন্ডিকেটের প্রধান আব্দুস শুক্কুর ওরফে তেল শুক্কুর নব্বইয়ের দশকের দিকে মহিষ চরাতেন। ওই দশকের শেষ দিকে তেল চোর সিন্ডিকেটে জড়িয়ে বদলে যায় তার ভাগ্য।
চট্টগাম নগরীর পতেঙ্গা, ইপিজেড, কর্ণফুলী, সদরঘাট ও বন্দর এলাকাকে ঘিরে গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী। বর্তমানে তেল শুক্কুর বাহিনীর সদস্য ২০০ জনেরও বেশি। ২০০০ সাল থেকেই এই সিন্ডিকেটে তার একক আধিপত্য। তেল চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে একাধিকবার আটকও হয়েছিলেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত ও বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ এবং স্থানীয় যুবলীগ নেতা আখতারের ছত্রছায়ায় ‘নট আউট’ স্টাইলে বিগত ১৫ বছর ধরে করছেন তেল চুরি।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। তার নির্বাচনী এলাকা কর্ণফুলী থানার জুলধা ইউনিয়নে তেল শুক্কুরের বাড়ি। জাবেদের নির্বাচনেও বড় অঙ্কের অনুদান দিতেন শুক্কুর। এছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশেও বড় অঙ্কের অনুদান দিতেন তিনি।
এ ছাড়া স্থানীয় ইপিজেড, পতেঙ্গা থানা, ডিপোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কোস্টগার্ডকেও দিতেন নিয়মিত মাসোয়ারা। তাই কখনো আটক হলেও বেশিদিন থাকতে হতো না জেলহাজতে। জামিনে এসেও ফের চুরিতে জড়াতেন তিনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুতির পরও পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। নতুন ক্ষমতা পাওয়া প্রশাসন, স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতা ও তেল-সংশ্লিষ্টদের মোটা অঙ্কের টাকায় ম্যানেজ করে এখনো নিয়মিত তেল চুরি করছেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রও বলছে, শুক্কুরের বিরুদ্ধে তেল চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ১৮টির অধিক মামলা রয়েছে। একাধিকবার আটকও হয়েছেন তিনি। ২০০০ সাল থেকে তেল চুরির অভিযোগ থাকলেও তিনি তেল বিক্রির জন্য ২০১৪ সালে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড থেকে তেল বিক্রির লাইসেন্স নেন। তার দৈনিক ৪০ ড্রাম তেল বিক্রির সুযোগ থাকলেও শতাধিক ড্রাম পাচার করছেন। কখনো হাজার ব্যারেল তেল পাচার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, তেল চুরি টাকা থেকে এখন অন্তত শতকোটি টাকার মালিক। চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বাইরেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সবাইকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার কারণে কেউই তার বিরুদ্ধে কথা বলেন না।
শুধু তেল চুরি নয়, কর্ণফুলী নদীর পাঁচটি ঘাটে বৈধ ইজারা পায় খাজা শিপিংলাইন্স। কিন্তু তাদের কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না ‘তেল শুক্কুর’ বাহিনী। তারা ৯০টি অয়েল ট্যাংকারের নাবিকদের ঘাট পারাপার, রশি বাঁধা এবং জাহাজ পরিষ্কারের কাজ করতে বাধা দিচ্ছে। তেল শুক্কুর বাহিনীকে মাসে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা মাসোয়ারা দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে খাজা শিপিংলাইন্সকে।
খাজা শিপিং লাইন্সের মালিক মো. ইকবাল হোসেন রেহান সম্প্রতি সাংবাদিকদের আক্ষেপ করে বলেন, তারা তিনটি বড় কোম্পানি এবং বেশ কয়েকটি কোম্পানির ৯০টি অয়েল ট্যাংকারের বৈধ ঠিকাদার। তবে সম্প্রতি তেল শুক্কুর বাহিনী তাদের কাজে বাধা দিচ্ছে। কর্মচারীদের মারধর করছে এবং মৃত্যুর হুমকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, তারা আমাদের বৈধ আয়ও জোর করে ছিনিয়ে নিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর পতেঙ্গা, ইপিজেড, কর্ণফুলী, সদরঘাট ও বন্দর এলাকাকে ঘিরে তেল চোর সিন্ডিকেটের তৎপরতা চলে। বিদেশে থেকে তেলসহ খাদ্যপণ্য নিয়ে আসা জাহাজ থেকে তেল সংগ্রহ করে এসব এলাকায় মজুদ করা হয়। এর সাথে যুক্ত রয়েছেন কিছু অসাধু নাবিক।
জাহাজে থাকা নাবিক এবং ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য খাবারসহ ‘জরুরি মালামাল পৌঁছে দেওয়ার’ অজুহাতে মাঝিরা নৌকায় করে তেল সংগ্রহ করেন। পরে ওই তেল ভাউচার করে খোলা বাজারে বিক্রি করে।
অনেক সময় জাহাজ থেকে তেল সংগ্রহ করে চক্রের নিজস্ব গোপন ডিপোতে মাটির নিচে ট্যাংকে লুকিয়ে রাখে। পরে সুবিধাজনক সময়ে স্থানীয় পেট্রোল পাম্প, ইঞ্জিনচালিত বোট এবং লাইটার জাহাজে বাংকারিং করা হয়।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল লিমিটেডের তেল জাহাজে করে সারা দেশে পরিবহনের সময় চুরি করে। তেল লোড করে প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ডিপোতে যাওয়ার সময় ছোট ছোট মোটর লাগিয়ে ড্রাম ভর্তি করা হয়। পরে সমুদ্রের উপক‚লে এনে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়।
সা¤প্রতিককালের এই গোয়েন্দা তথ্যও বলছে, আমদানি করা জ্বালানি তেল প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে ডিপোগুলোতে আনা হয়। এরপর ডিপো থেকে সড়ক, রেল ও নদীপথে ট্যাংকার, ট্যাংক লরি ও রেল ওয়াগনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় নানা স্তরে তেল চুরি হয়। যার পেছনে রয়েছেন তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা, স্থানীয় সিন্ডিকেট, জাহাজের নাবিক ও অন্যান্য সহযোগী। তেল পরিবহনে ব্যবহৃত ২০০ লিটারের প্রতিটি ড্রামে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে গড়ে ১৫ থেকে ২০ লিটার করে অতিরিক্ত তেল ভরে দেওয়া হয়। যা পরবর্তীতে কালোবাজারে চলে যায়।
এ বিষয়ে জানতে আব্দুস শুক্কুরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিপিসি পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান জানান, চুরির বিষয়টি উদ্বেগজনক। আমরা ডিপোগুলোকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার কাজ শুরু করেছি। পাশাপাশি অভিযান পরিচালনায় কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সদরঘাট থানার ওসি নাজিম উদ্দিন বলেন, আমি এই থানায় আসার পর তেল চুরি নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। যাদের তেল চুরি হয় তারা আগে অভিযোগ করেছেন কি না আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
ইপিজেড থানার ওসি মোহাম্মদ আখতার উজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব।