শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. শামীম মিয়া

প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২৫, ০৮:৩১ এএম

উপজাতি শিশুদের জীবনমান : শিক্ষা, বাল্যবিবাহ ও দারিদ্র্যের চক্র

মো. শামীম মিয়া

প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২৫, ০৮:৩১ এএম

উপজাতি শিশুদের জীবনমান : শিক্ষা, বাল্যবিবাহ ও দারিদ্র্যের চক্র

বাংলাদেশ বহুজাতিগোষ্ঠীর একটি দেশ। এখানে বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ, পাহাড়ি চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে শতাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করে। সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, মাহলি, পাহান, খাসিয়া, গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মণিপুরী প্রভৃতি জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও জীবনযাত্রার ধারা বহন করছে শত শত বছর ধরে।

তবে উন্নয়ন অগ্রযাত্রার মূলধারার বাইরে থাকায় এদের বিশেষ করে শিশুরা নানা সংকটে ভুগছে। শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, অল্প বয়সে বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং সামাজিক বৈষম্যÑসব মিলিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এই সংকট কেবল ব্যক্তিগত নয়; এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্য ও বৈষম্যের চক্রকে জিইয়ে রাখছে। এই সম্পাদকীয়তে আমরা শিক্ষা, বাল্যবিবাহ ও দারিদ্র্যের আন্তঃসম্পর্কিত প্রভাব বিশ্লেষণ করব, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট দেখব এবং কার্যকর সমাধানের পথ খুঁজব।  

শিক্ষা :

অধিকার নয়, অনেক সময় বিলাসিতা : জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, শিক্ষা প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ সরকারও প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, উপজাতি শিশুদের জন্য শিক্ষা প্রায়ই অধরা থেকে যায়। 

স্কুলে ভর্তির হার বনাম সম্পন্ন করার হার :

ইউনিসেপের ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হার প্রায় শতভাগ হলেও প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার হার জাতীয় গড়ে ৭৮%। তবে অঞ্চলভেদে বৈষম্য প্রকট। উপজাতি শিশুদের মধ্যে এই হার অনেক সময় আরও কমে যায়। অনেক শিশু প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির পরেই ঝরে পড়ে।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় রংপুরের চতরা গ্রামের কথা। প্রায় দুই হাজার সাঁওতাল বাস করা এই গ্রামে একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। কিন্তু শিক্ষাদান পুরোপুরি বাংলায়। সাঁওতাল শিশুরা ঘরে নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বললেও স্কুলে তাদের বাংলা বুঝতে হয়। প্রথম দিন থেকেই তারা পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষকরা স্থানীয় ভাষা জানেন না, ফলে শিশুদের শেখার আগ্রহ ভেঙে যায়। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা স্কুল থেকে ছিটকে যায়। 

ঝরে পড়ার কারণ :

ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা না থাকায় বোঝার সমস্যা হয়। অর্থনৈতিক চাপ,  শিশুদের ছোট বয়স থেকেই মাঠে কাজ করতে হয় বা পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে হয়। মেয়ে শিশুদের গৃহস্থালি দায়িত্ব, রান্না, পানি আনা, ছোট ভাইবোনকে দেখা, আর কিশোরী বয়সে বিয়ের চাপ। অপ্রতুল অবকাঠামো, অনেক উপজাতি গ্রামে স্কুল নেই; নিকটবর্তী স্কুলে যেতে কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয়। শিক্ষকের সংকট, প্রশিক্ষিত ও সংস্কৃতি সংবেদনশীল শিক্ষক নেই। 

ফলাফল :

শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে কেবল লেখাপড়া না জানা নয়। এটি তাদের আধুনিক কৃষি পদ্ধতি, স্বাস্থ্যবিধি, নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা সম্পর্কে অজ্ঞ রাখে। ফলে দারিদ্র্যের শিকল ভাঙতে না পেরে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রান্তিক থেকে যায়। 

বাল্যবিবাহ :

সামাজিক অভিশাপ, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার বিশ্বে অন্যতম। ইউনিসেপের ২০২২ সালের তথ্যমতে, ২০-২৪ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে ৫১% নারী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়েছে। বিডিএইচএস (২০১৭-১৮) অনুযায়ী, এই হার ছিল প্রায় ৫৯%। 

উপজাতি সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি :

উপজাতি মেয়েদের মধ্যে এই হার আরও বেশি। দারিদ্র্য, মেয়েদের শিক্ষার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে পরিবারগুলো মনে করে অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দেওয়াই উত্তম। ফলে ১৩-১৫ বছর বয়সেই অনেক মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়।

পরিণতি :

এক. স্বাস্থ্যঝুঁকি :  অল্প বয়সে গর্ভধারণের ফলে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতক মৃত্যুহার বেড়ে যায়। ডব্লিউএইচও-এর তথ্যমতে, ১৫-১৯ বছর বয়সি মায়েদের মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি দ্বিগুণ। দুই. শিক্ষা থেকে বঞ্চনা : বিয়ে মানেই স্কুল জীবন শেষ। ফলে মেয়ে শিশুরা তাদের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ হারায়। তিন. মানসিক চাপ : কিশোরী বয়সে গৃহস্থালি ও শারীরিক সম্পর্কের চাপ অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। চার. প্রজন্মান্তর দারিদ্র্য : শিক্ষা না থাকায় ও স্বল্প দক্ষতার কারণে তারা দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের হতে পারে না। 

দারিদ্র্য : অব্যাহত জীবনসংগ্রাম : দারিদ্র্য উপজাতি শিশুদের জীবনের কেন্দ্রীয় সমস্যা। অধিকাংশ পরিবার ভূমিহীন। কারো জমি থাকলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। কৃষিকাজ মৌসুমি, সারা বছর আয় থাকে না। 

জীবিকা : পুরুষেরা দিনমজুরি, ইটভাটায় কাজ বা শহরে রিকশা চালায়। নারীরা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। শিশুদেরও পরিবারে কাজ করতে হয়Ñ কেউ চাষের জমিতে শ্রম দেয়, কেউ ইটভাটায়, কেউ শহরে গৃহকর্মী হয়। ফলে পড়াশোনার সুযোগ নষ্ট হয়। 

পুষ্টিহীনতা : বাংলাদেশের জাতীয় গড়েই শিশুর মধ্যে অপুষ্টিজনিত খর্বকায় প্রায় ২৪%। কিন্তু উপজাতি শিশুদের মধ্যে এটি অনেক বেশি (ইউনিসেপ, ২০২১)। অপুষ্টির কারণে তাদের উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম, ওজন স্বাভাবিকের নিচে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। 

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা :

গ্রামাঞ্চলের উপজাতি এলাকায় সাধারণত স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র দূরে, পরিবহন খরচও বহন করা সম্ভব নয়। ফলে শিশুরা সহজ রোগ যেমন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জন্ডিসে মারা যায়। অনেক সময় তারা স্থানীয় কবিরাজ বা ঝাড়ফুঁক নির্ভর চিকিৎসা নেয়।

৪. স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক বৈষম্য : উপজাতি শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম। অনেক শিশু জন্মের পর নিবন্ধিত হয় না, ফলে তারা রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকে। 

টিকাদান কর্মসূচি :

জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি (ইএফআই) শহরে অনেক সফল হলেও প্রান্তিক উপজাতি গ্রামে নিয়মিত হয় না। ফলে হাম, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি ইত্যাদি প্রতিরোধযোগ্য রোগের ঝুঁকি বেশি। 

সামাজিক বৈষম্য :

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপজাতি শিশুদের অনেক সময় বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হয়। তাদের ভাষা, পোশাক, নাম নিয়ে উপহাস করা হয়। কর্মক্ষেত্রেও তারা একই সমস্যায় পড়ে। ভূমি দখল, সামাজিক প্রভাবশালীদের হয়রানি, ন্যায্য মজুরি না পাওয়াÑসব মিলিয়ে আত্মবিশ্বাস ক্ষয়ে যায়। 

৫. সরকারের পদক্ষেপ ও সীমাবদ্ধতা : পদক্ষেপ এক. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-১৮ বছরের নিচে বিয়ে নিষিদ্ধ। দুই. প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক আইন : স্কুলে ভর্তি ও উপবৃত্তি নিশ্চিত। তিন. বিদ্যালয়ভিত্তিক খাদ্য কর্মসূচি : শিশুদের পুষ্টি ও উপস্থিতি বাড়ানো। চার. ক্ষুদ্রঋণ ও কর্মসংস্থান প্রকল্প  : গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার চেষ্টা। 

সীমাবদ্ধতা :

আইন প্রয়োগ দুর্বল। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাল্যবিবাহ গোপনে সম্পন্ন করে। উপজাতি ভাষাভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক সীমিত। শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামো দুর্বলতা। স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ওষুধের ঘাটতি। 

৬. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও এনজিওর ভূমিকা, জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেপ), ঝধাব ঃযব ঈযরষফৎবহ, ইজঅঈ, কারিতাসসহ বিভিন্ন সংস্থা উপজাতি শিশুদের জন্য কাজ করছে।

শিক্ষা :

কিছু এলাকায় মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেছে।

আবাসিক বিদ্যালয় :

মেয়েদের নিরাপদে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে। স্বাস্থ্যসেবা : মোবাইল ক্লিনিক ও টিকাদান ক্যাম্প করছে।

সচেতনতা :

বাল্যবিবাহের ক্ষতি নিয়ে গ্রামে প্রচারণা। তবে এগুলো সীমিত ও বিচ্ছিন্ন; সারা দেশে প্রভাব ফেলতে আরও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। 

৭. সুপারিশ : এক. শিক্ষা প্রসার : স্থানীয় ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা, উপযুক্ত পাঠ্যসামগ্রী, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, আবাসিক বিদ্যালয়।

দুই. সচেতনতা বৃদ্ধি  :

বাল্যবিবাহ ও অপুষ্টির ক্ষতি নিয়ে গ্রামভিত্তিক প্রচারণা।

তিন. স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ :

উপজাতি গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মোবাইল ক্লিনিক, মাতৃ-শিশু পুষ্টি কর্মসূচি।

চার. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন :

ক্ষদ্রঋণ, কর্মসংস্থান, কৃষি প্রযুক্তি সহায়তা, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন।

পাঁচ. আইন প্রয়োগ :

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের জবাবদিহি।

ছয়. সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি :

উপজাতি ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে মূলধারার শিক্ষা ও গণমাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা। বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে দ্রুত এগোচ্ছে। কিন্তু উপজাতি শিশুদের জীবনমান এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ঘাটতিতে পিছিয়ে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও বৈষম্যের শিকল না ভাঙলে তাদের জন্য আলোকিত ভবিষ্যৎ কল্পনা করা সম্ভব নয়। এই চক্র ভাঙতে হলে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।

একই সঙ্গে মূলধারার সমাজকেও মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। উপজাতি শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করা শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়; এটি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও সাম্যের সমাজ গঠনের অপরিহার্য শর্ত। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপদ শৈশব নিশ্চিত করতে পারলেই উপজাতি শিশুদের হাসি ভরা জীবন ও স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা সম্ভব।

মো. শামীম মিয়া, 
শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, সাঘাটা গাইবান্ধা

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!