ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের যোগ্যকর্তা শহরের একটি মোড়ে বড় করে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। সেখানে লেখা বার্তাটি হলো, ‘সিস্টেম রিসেট করুন।’ দেখেই বোঝা যায়, তাড়াহুড়ায় ছিলেন শিল্পী। সবুজ-গোলাপি রঙের বার্তাটি কাঁচা হাতে লেখা হলেও এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়াজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ-আন্দোলনের সময় এটি আঁকা হয়। বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়ার গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে এএফপির প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য, আইনপ্রণেতাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইন্দোনেশিয়াজুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
শুরু থেকেই এই বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় গোলাপি ও সবুজ রঙ। জাকার্তার প্রতিনিধি পরিষদ ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে প্রতিবাদ জানান এক নারী। তার পরনে ছিল গোলাপি রঙের হিজাব। ভবনের সামনে প্রহরারত পুলিশের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই তিনি তার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। ২১ বছর বয়সি ডেলিভারিম্যান আফফান কুরনিয়াওয়ানের সঙ্গে সবুজ রঙকে মিলিয়েছে ইন্দোনেশীয়রা। আধা-সামরিক পুলিশ বাহিনীর একটি সশস্ত্র গাড়ি তাকে চাপা দেয়। আফফানের এই করুণ মৃত্যু ডেলিভারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের ক্ষোভের কারণ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ওই খাতের কর্মীদের বেতন কমানো ও কর্মঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার আফফান সবুজ রঙের জ্যাকেট পরে খাবার ডেলিভারি দিতে যাচ্ছিলেন। সে সময় পুলিশের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে নিহত হন তিনি। ইন্দোনেশিয়ায় ডেলিভারি সেবায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সবুজ রঙের পোশাক পরার প্রচলন রয়েছে। রাজধানী জাকার্তায় অফিসকর্মী দিলা তার ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইলে উজ্জ্বল সবুজ ও গোলাপি রঙের ফিল্টার দেন। নিজের পুরো নাম জানাতে অস্বীকার করেন দিলা (২৮)। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন নিজেদের মধ্যে একাত্মতা প্রয়োজনÑ আরও অনেক দূর পথ পাড়ি দিতে হবে।’ পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার আনতে হবে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত থাকতে পারে না’, বলেন তিনি। দিলা আরও মন্তব্য করেন, ‘এটা শুধু এখনকার বিক্ষোভের কারণে নয়। বরং আগের সব উদাহরণ থেকে আমরা এটা বুঝতে পারছি।’ প্রায় এক বছর আগে সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল প্রাবোও সুবিয়ান্তো ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশটিতে এটাই সবচেয়ে বড় বিক্ষোভের ঘটনা। বিক্ষোভের মন্ত্র হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ‘সাহসী গোলাপি, বীর সবুজ’ শ্লোগান। বিক্ষোভের দমকে পার্লামেন্ট সদস্য ও প্রেসিডেন্টের সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
প্রস্তাবিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ছিল পার্লামেন্ট সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ ও বাড়িভাড়ার জন্য বিশেষ ভাতা। ওই ভাতার পরিমাণ জাকার্তায় ন্যূনতম বেতনের ১০ গুণেরও বেশি। অপরদিকে, চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি অনেকটা চাঙ্গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মূলে আছে উৎপাদন ও রপ্তানি চাহিদা বৃদ্ধি। তা সত্ত্বেও, দেশের সাধারণ জনগণ এর সুফল উপভোগ করতে পারছে না। ইন্দোনেশীয়দের মত, একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক শ্রেণি নিজেদের ধন-সম্পদ বাড়িয়েই যাচ্ছে আর অপরদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য নতুন মাত্রায় পৌঁছে গেছে। অফিসকর্মী দিলা এএফপিকে বলেন, ‘পুরো সিস্টেমেই দুর্নীতি। সরকার, পার্লামেন্ট ও সাধারণ জনগণের মধ্যে রয়েছে বিশাল ফারাক।’
অন্য আরও অনেকের মতো দিলাও ‘সাহসী গোলাপি বীর সবুজ’ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। এখন পর্যন্ত যারা বিক্ষোভে যোগ দেননি বা এ বিষয়ে জানেন না, তাদের অনলাইনে সচেতন করছেন তিনি। অনেকেই নিজেই সবুজ-গোলাপি রঙে ছবি আঁকছেন। আবার অনেকে বিনা মূল্যে ব্যবহারযোগ্য ওয়েবসাইট দিয়ে ছবি তৈরি করে নিচ্ছেন। বুধবার একটি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, বিক্ষোভে অন্তত ১০ জন নিহত ও ১০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
ইন্দোনেশিয়ায় হাজারো শিক্ষার্থী বৃহস্পতিবার রাজধানী জাকার্তায় পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করে, এমনটি জানায় একটি ছাত্রসংগঠন। কারণ সরকারের সঙ্গে একটি বৈঠক এখনো সম্পন্ন হয়নি। বিশাল বিক্ষোভের পর গত সপ্তাহে ১০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় এই আলোচনা নির্ধারিত ছিল।
গত সপ্তাহের বিক্ষোভ মূলত পুলিশি সহিংসতা এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচনকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। এতে ছাত্র, শ্রমিক এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো নেতৃত্ব দিচ্ছে। পুলিশের গাড়িচাপায় ট্যাক্সিচালকের মৃত্যুর ঘটনায় এই বিক্ষোভ তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। খবর রয়টার্সের।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন