বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গেলে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফল অনিবার্য। বিএনপির ছাত্র সংগঠন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পারফরম্যান্স শুধু শিক্ষার্থী রাজনীতিতে নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্ব বহন করে। তবে সম্প্রতি নির্বাচনের পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণ দেখাচ্ছে যে, ছাত্রদল ও বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে দূরত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডাকসুতে ভোটের হার প্রমাণ করছে যে, ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সমাজের বড় অংশের সমর্থন পেতে ব্যর্থ। তাদের নিজস্ব শক্তি যতটা মনে করা হয়, ভোটের পরিমাণ অনুযায়ী তা ততটা নেই। জাকসুতে নির্বাচনে ভোট বর্জন করে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার ফলে তাদের প্রকৃত সাংগঠনিক শক্তি বোঝার সুযোগও সীমিত হয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, শিক্ষার্থী সংগঠনের ব্যর্থতা কি শুধু ছাত্রদলের, নাকি বিএনপি হাইকমান্ডের ব্যর্থতার ফল? রাকসু ও চাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পরিণতি কি আরও গুরুতর হতে পারে? বিএনপি যদি এই সংকটের সময় সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে তা ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হবে। বিএনপির নেতৃত্বের সিনিয়ররা মূলত আশির দশকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আছেন। তারা বর্তমান জেন-জি প্রজন্মের চিন্তাভাবনা, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, এবং বৈশ্বিক প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে দুর্বল। এই দুই দশকে বাঙালি মুসলিম সমাজে ধর্ম, নৈতিকতা ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন বোঝার আগ্রহ নেই। মানুষের মধ্যে যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও ক্ষমতার অপব্যবহার করবে না, আর্থিক দুর্নীতি ও পাচারের সঙ্গে যুক্ত হবে নাÑ এটি সিনিয়র নেতারা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ। তাদের কাজ, বক্তব্য, এবং টকশোতে যে নৈতিক শক্তির ঝলক আশা করা যায়, তা দেখা যায় না।
মধ্যবয়সি নেতাদের দাম্ভিক আচরণ ও অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক বক্তব্য নতুন প্রজন্মের তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে প্রত্যাখ্যানযোগ্য। ডাকসু নির্বাচনের সময় ছাত্রদলের নেতা ও সভাপতি যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ভিসির সঙ্গে আচরণ করেছেন, তা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সরাসরি মানুষের সামনে এসেছে। অভব্য আচরণ ছাত্রদলের প্রচেষ্টা ও নৈতিকতার প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। বড় দলের নেতাদের আচরণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে, তা আওয়ামী লীগ হোক বা বিএনপি। বিএনপির রাজনৈতিক বক্তব্যে ভারতীয় আধিপত্যবাদ, পলাতক আওয়ামী লীগ এবং দেশীয় গুপ্ত আধিপত্যবাদের বিষয়গুলো জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে। এ বিষয়ে বিএনপির বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিক্রিয়া নড়বড়ে, যা সমর্থক ও নতুন প্রজন্মকে দ্বিধান্বিত করছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়া বক্তব্যগুলো জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- বিএনপি তার পুরোনো রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করছে। দলীয় কৌশল হিসেবে বা মিত্রদের ইচ্ছা অনুযায়ী এই দূরত্ব তৈরি হচ্ছে কি, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এই দূরত্ব কমানোর কোনো উদ্যোগ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। পুরোনো মিত্রদের দূরে ঠেলে দিলে বিরোধী জোট শক্তিশালী হতে পারে, যা বিএনপির জন্য রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে জেন-জি প্রজন্মের মনোভাবের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রায় ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে নতুন ৪ কোটি ভোটার এই প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই প্রজন্মের মনোভাব বোঝা, তাদের আকাক্সক্ষা ও মানসিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা বিএনপির জন্য এখন প্রয়োজনীয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল ফ্যাসিবাদ দূর করার উদ্দেশ্যে। বিএনপি যদিও সুবিধাভোগী, তবে তা তাদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। নতুন প্রজন্ম জীবন দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। এই প্রজন্মকে কেবল ‘এনসিপি’ বা যেকোনো পুরোনো রাজনৈতিক ধারণায় সীমাবদ্ধ ধরা ভুল। নতুন প্রজন্মকে বোঝা না গেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল ও বিপজ্জনক হতে পারে।
পুরোনো রাজনীতির প্রভাব, দুর্নীতি, দখল ও পাচারের সংস্কৃতি দিয়ে নতুন প্রজন্মের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নতুন ধারার নৈতিক রাজনীতি ছাড়া দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুস্থ রাখা কঠিন। জনগণ বিএনপির মধ্যে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের দস্যুবৃত্তির ছায়া দেখতে চায় না। শক্তি বা স্লোগান দিয়ে মানুষের মন জয় করা সম্ভব নয়। অনেকে মনে করেন, ছাত্র সংসদের নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না। তবে ডাকসু ও জাকসুর ফলাফল দেখাচ্ছে, জনগণের মনোভাব এখানে পরোক্ষভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহও দেখাচ্ছে, নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক মনোভাব দেশের ভবিষ্যৎ প্রভাবিত করতে পারে। বিএনপি যদি এই বাস্তবতা না মেনে পদক্ষেপ না নেয়, তবে দলীয় ও জাতীয় রাজনৈতিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে।
ডাকসু, জাকসু নির্বাচন হলো দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ট্রেলার মাত্র। সামনে রয়েছে রাকসু ও চাকসু নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে জেন-জি প্রজন্মের মনোভাব গভীরভাবে যুক্ত। বিএনপিকে নতুন প্রজন্মের আকাক্সক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নৈতিক ও দায়িত্বশীল রাজনীতি, মানুষের আস্থা অর্জন এবং রাজনীতিতে সৎ আচরণ ছাড়া ভবিষ্যতে দল ও দেশের জন্য নিরাপদ পথ সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলা যায়, বিএনপির রাজনৈতিক সংকট মূলত ছাত্রদলের দুর্বল পারফরম্যান্স, সিনিয়র নেতৃত্বের পুরোনো রাজনৈতিক মানসিকতা, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে দূরত্ব, এবং রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে দূরত্বের সমন্বয়। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সূচক হিসেবে কাজ করছে। নতুন প্রজন্মের মনোভাব বোঝা, নৈতিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা এবং সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ডাকসু থেকে চাকসুÑএটি শুধু নির্বাচন নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বড় সংকেত। বিএনপির জন্য প্রয়োজন সতর্কতা, নতুন প্রজন্মকে বোঝার মানসিকতা, এবং নৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা। পুরোনো প্রথা, দখল-পাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার দিয়ে ভবিষ্যৎ রক্ষা করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বিএনপির দায়িত্ব ও পদক্ষেপ দেশের গণতন্ত্র ও দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
এস এম হাসানুজ্জামান, কলামিস্ট
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন