সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সন্ত্রাস, ছিনতাই, মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষের জীবন চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে একাধিক হত্যাকা-, ছিনতাই বা গ্যাং সহিংসতার খবর। এ অবস্থা কোনোভাবেই সভ্য সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
রূপালী বাংলাদেশে ‘সন্ত্রাসে কাঁপছে মিরপুর-মোহাম্মদপুর’ শিরোনামের বিশেষ প্রতিবেদনে এই দুই এলাকার যে চিত্র উঠে এসেছে তা রীতিমতো উদ্বেগের।
প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাংয়ের ৬০টি গ্রুপ। অন্যদিকে, মোহাম্মদপুরের বসিলা বেড়িবাঁধ, ঢাকা উদ্যান, জেনেভা ক্যাম্প কিংবা টাউন হলসংলগ্ন বিহারি ক্যাম্পÑ এসব এলাকাকে কেন্দ্র করে অপরাধীদের আধিপত্য বহুদিনের। মিরপুরের পল্লবী ও আশপাশের এলাকায় কিশোর গ্যাং ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শুধু মাদক ব্যবসা বা ছিনতাই নয়, প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো, টার্গেট কিলিং কিংবা কোটি টাকার চাঁদা দাবি করাও এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এসব অপরাধচক্রের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আর্থিক লেনদেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যের মদতও যে রয়েছেÑ তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব এলাকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়ারা থেকে শুরু করে সাধারণরাও আতঙ্কে কাটাচ্ছেন দিন।
চিন্তার বিষয় হলো, এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হলেও খুব দ্রুত তারা জামিনে বেরিয়ে আবারও একই অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক সন্ত্রাসী জেল থেকেই অনুসারীদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযান সত্ত্বেও অপরাধ দমন সম্ভব হচ্ছে না। বাস্তবতা হলোÑ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিশ্রুতি থাকলেও সন্ত্রাসীরা এখনো ‘অপরাজেয়’ ভাব নিয়েই এলাকায় রাজত্ব করছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাবে? প্রথমত, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ না করলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না। যেকোনো দলের ছত্রছায়ায় অপরাধীদের বাঁচতে দেওয়া মানে পুরো সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং লিডারদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা বারবার জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় অপরাধে জড়াতে না পারে। তৃতীয়ত, এসব এলাকায় মাদক ব্যবসার শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে, কারণ কিশোর গ্যাংয়ের বড় অংশই মাদকাসক্ত ও মাদকনির্ভর। চতুর্থত, পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীকে সমন্বিতভাবে দীর্ঘমেয়াদি অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
রাজধানীর হৃদয়ে যদি সন্ত্রাসীরা অবাধে বিচরণ করে, তবে তা গোটা দেশের জন্যই হুমকির বার্তা। সারা দেশে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য প্রতিদিনই বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ সংঘটিত অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া। তাই সন্ত্রাস নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মুখোশ উন্মোচন না করলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের আশা অধরাই থেকে যাবে।
শুধু সরকারের ওপর দায় চাপালেই দায়িত্ব শেষ হবে না, বরং প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা, সাহস ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে।
সর্বোপরি, জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। এলাকাবাসী ভয়ে মুখ না খুললে কিংবা থানায় অভিযোগ করতে সাহস না পেলে অপরাধীরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এ জন্য রাষ্ট্রকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন