১.
বই আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়, আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত ও সুবাসিত করে। একটি ভালো বই হচ্ছে মনের খোরাক এবং জ্ঞানের ভান্ডার। জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে নিজেকে ও বিশ্বকে জানতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বই সভ্যতার সূতিকাগার, স্বপ্নের কারিগর এবং একজন বিশ্বস্ত বন্ধু। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম নাজিলকৃত আয়াতের প্রথম শব্দ - ‘ইকরা’ বা পড়ো। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টি বান্দাদের পড়ার জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য উৎসাহিত করেছেন। আমাদের জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের জাগতিক, নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চ সোপানে উপনীত হওয়ার প্রধান উপকরণ হলো বই। শিক্ষার জন্য বই-ই আলোর পথের সহযাত্রী। বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক যত নিবিড় হবে, সেই মানুষ তত উন্নত চিত্ত ও বিত্তের অধিকারী হবে। ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘একজন তরুণ বা তরুণী যখন একটি বই কিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে, তখন আমি তাদের চোখে-মুখে অসংখ্য শুকতারা ঝলমল করতে দেখি। ’
বই আমাদের চিরন্তন বন্ধু, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রসিদ্ধ ভান্ডার। বই মানবজীবনকে যেমন মহৎ করে সঠিক গন্তব্যে চলতে সহযোগিতা করে, তেমনি ইতিহাসের আলোকে পথ প্রদর্শন করে ভবিষ্যৎ সফলতার বীজ বুনতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে আগামীর স্বপ্ন দেখায়, বাঁচতে শেখায়। বই আমাদের উদার ও মানবিক হতে শিক্ষাদান করে। বই পড়া জীবনের শ্রেষ্ঠ অভ্যাসগুলোর অন্যতম সু-অভ্যাস। একটি ভালো বই একজন শিক্ষকের মতো পাঠককে জ্ঞান দান করে। পারস্যের বিখ্যাত কবি, দার্শনিক ও গণিতবিদ ওমর খৈয়াম লিখেছেন,
‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে
বই, সে তো অনন্ত যৌবনা। ’
আমরা বিশ্বের বিভিন্ন গুণী ও বরেণ্য মানুষের জীবনী পাঠ করলে জানতে পারি, তাঁদের প্রত্যেকের জীবনই বইয়ের সঙ্গে নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বিপ্লবী নেতা চে’ গুয়েভারা সব সময় বন্দুকের সাথে পাবলো নেরুদার ‘কান্তো জেনারেল’ বইটি রাখতেন। জগৎখ্যাত আলেকজান্ডার দিনের একটি বিশেষ সময় বই পড়ায় মনোনিবেশ করতেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যুদ্ধক্ষেত্রেও বই সাথে রাখতেন। তাঁর শয়নকক্ষের পাশে ছিল বিশাল সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। আমাদের এই সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব মনীষী প-িত ব্যক্তি, নেতৃত্ব দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন, আলোকিত করেছেন, তাঁদের সবাই নিজে প্রচুর পরিমাণে বই পড়েছেন এবং অন্যদেরও বই পড়তে উৎসাহিত করেছেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘বই পড়াকে যে যথার্থ হিসেবে নিতে পারে, সংসারের দুঃখ-কষ্টের বোঝা তার অনেকখানি কমে যায়। ’
২.
গণমানুষের চিন্তা-চেতনার ধরন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রগতি ও সম্প্রীতির এক উৎসব বইমেলা। বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বইমেলা। বই ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও এই মেলায় পারস্পরিক শিক্ষা, ঐতিহ্য, বিনোদনের আদান-প্রদান ও সেতুবন্ধ ঘটে। লেখক, গবেষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের জনগণ, পাঠক ও সাধারণ মানুষের উৎসব-আনন্দ আর মহামিলনমেলায় জ্ঞানের সমন্বয় ঘটে বইমেলায়। বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা, জ্ঞানের মেলা। বইমেলা আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। অমর একুশে বইমেলা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারাকে সামনে এগিয়ে নিতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে ও অনুপ্রেরণা জোগায়।
মুক্তধারা প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের মহান ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি চত্বরে চাটাই বিছিয়ে ৩২টি বই নিয়ে এই মহান মেলার শুভ সূচনা করেন। বাংলা একাডেমি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলা পরিচালনা করে আসছে এবং ২০২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলার নামকরণ করা হয় অমর একুশে বইমেলা। বইমেলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনার, লেখক-পাঠকদের অংশগ্রহণ ও সাক্ষাৎকারের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপকতা এবং হাজার বছরের সম্মৃদ্ধির ইতিহাস বিশ্ববাসী অবগত হন।
দেশের বইপ্রেমী মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন অমর একুশের বইমেলার জন্য। এখানে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে বইমেলা একটি মহা-উৎসবে পরিণত হয়। মেলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার, লেখক-পাঠকদের অংশগ্রহণ ও সাক্ষাৎকারের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপকতা এবং হাজার বছরের সম্মৃদ্ধির ইতিহাস বিশ্ববাসী অবগত হন। একুশের বইমেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন পাঠক ও লেখক সৃষ্টি এবং বই পড়ার প্রতি দেশের সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই এই ধরনের মেলার আয়োজন করা হয়।
৩.
মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর পঞ্চদশ শতকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বিশ্বের প্রথম বইমেলার সূচনা হয় এবং তা ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। আবার অনেকে জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলার সূচনা হয়েছিল বলে অভিমত পোষণ করেন। ১৭ শতকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে বইমেলা জনপ্রিয়তা লাভ করে। বুক এক্সপো আমেরিকা, লন্ডন বুক ফেয়ার, কলকাতা বইমেলা, নয়াদিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা ইত্যাদি বইমেলা আন্তর্জাতিকভাবে খুবই পরিচিতি লাভ করেছে।
বাংলাদেশের বইমেলার সূচনার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দিন ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে শিশু-কিশোরদের জন্য তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরিতে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি) একটি বইমেলার আয়োজন করেন। এটাই বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। সরদার জয়েনউদ্দিন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে নারায়ণগঞ্জে আরো একটি বইমেলার আয়োজন করেন, সেখানে বইমেলার পাশাপাশি আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করেন শহিদ অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ম্হুাম্মদ আব্দুল হাই ও সরদার ফজলুল করিম।
বই জ্ঞান ও আনন্দের প্রতীক। বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি, পাঠকের সাথে লেখকের দেখা-সাক্ষাৎ ও মিলনমেলা, পারস্পরিক যোগাযোগ ইত্যাদি কারণে আমাদের জীবনে বইমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বইমেলায় লেখক-পাঠকদের মহামিলন হয়, জ্ঞানের বিস্তার ঘটে; মানুষ লেখক, কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। অনেকেই বইমেলা থেকে বই কেনে ও পড়ে মনীষী হিসেবে সুনাম অর্জন করে। বইমেলা থেকেই জ্ঞানের আলো, প্রীতি-সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, আন্তরিকতা, সামাজিকতা, উদারতা, নৈতিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই বইমেলা হচ্ছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মেলা। মানুষের অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার চিরন্তন আগ্রহ বই পড়েই মেটানো সম্ভব। একটি ভালো বই আমাদের মনের খোরাক এবং মানুষের ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক কওে তোলে।
৪.
বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশি এবং বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে বইমেলার আয়োজন করে থাকেন। সেখানে লেখক, পাঠক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সর্বশ্রেণির মানুষের সমাগম ঘটে। বিশ্বের যেখানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করছেন, সেখানেই ছোট-বড় পরিসরে বইমেলার আয়োজন করা হয়।
যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস বেশ পুরোনো। এখানে প্রায় ৮ লক্ষাধিক বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাংলা ভাষার মর্যাদা এবং এই প্রজন্মের কাছে বই পড়ার গুরুত্ব তুলে ধরতে সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, যুক্তরাজ্য এর আয়োজনে ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ বইমেলার আয়োজন করা হয়।
এটি ছিল বাংলাদেশ বইমেলার ১৩তম আয়োজন। সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, যুক্তরাজ্য-এর সভাপতি কবি মুহাম্মদ ইকবালের সভাপতিত্বে এবং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক উদয় শঙ্কর দুর্জয়ের সঞ্চালনায় বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মাহমুদ শাহ কোরেশি এই মেলার উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী শুভ্র দেব, বাংলা একাডেমি কর্তৃক পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি শামীম আজাদ, কানাডা থেকে আগত কবি রোকসানা লেইস এবং আবুল হাসিব অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্ট ও কমিউনিটি সেন্টারে বাংলাদেশ বইমেলা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বসবাসরত এবং বিভিন্ন দেশের বাঙালি অভিবাসী, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, কবি, গবেষক ও সাহিত্যপ্রেমীদের অংশগ্রহণে জমজমাট হয়ে ওঠে। এ ছাড়া ইংল্যান্ডের মূলধারার কয়েকজন লেখক ও কবি এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। মেলায় ছড়াকার দিলু নাসের, কবি আতাউর রহমান মিলাদ, কবি মোহাম্মদ মোসাইদ খান ও নাট্যজন স্মৃতি আজাদকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পদক ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। মেলায় স্টলে প্রবাসী ও দেশি লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের বই স্থান পায়। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পরে পূর্ব লন্ডনের বাংলা টাউন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে পরিচিত।
এখানে রয়েছে বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং বাংলাদেশি মানুষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ অবদান। প্রবাসে বসবাস করলেও এখানের অভিবাসীরা বাংলাদেশের উন্নয়নে নানামুখী কর্মকা- করে যাচ্ছেন। তৃতীয় বাংলায় বসবাসরত দেশপ্রেমিক ও সংস্কৃতিমনা লোকজন মনে করেন, বইমেলা, বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে এই প্রজন্মের সন্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হবে, বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। গবেষক ও সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশি অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে বইমেলা ও বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঘন ঘন হওয়া উচিত। কারণ এতে করে এ দেশের নতুন প্রজন্ম এবং বাংলাদেশের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা হবে, নতুন লেখক ও পাঠক সৃষ্টি হবে।
শাহ মনসুর আলী নোমান: গবেষক, শিক্ষা প্রশাসক ও কলাম লেখক; সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার, নর্থইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন