শহর থেকে গ্রামÑ সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী ভেজাল ওষুধ। এত সূক্ষ্মভাবে নকল ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে যে, ক্রেতাসাধারণের ধরার ক্ষমতার বাইরে। আর অসাধু ব্যবসায়ীরাও বেশি মুনাফার আশায় এসব দেদার বিক্রি করছেন। প্রাণদায়ী ওষুধ যখন প্রাণ হরণের কারণ হয়, তখন প্রশ্ন জাগতেই পারেÑ আমাদের দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? আমরা ভেজাল খাদ্য খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। প্রতিদিনই খাচ্ছি। জেনে বা না জেনে খাচ্ছি। সেই ভেজাল খাদ্য খেয়ে আমরা অসুস্থ হচ্ছি। সেই অসুখ ভালো করার জন্য আবার যে ওষুধ বিশ^াস করে খাচ্ছি, এখন সেই ওষুধও নকল বের হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজালÑ তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? এদিকেও মরতে হবে, ওদিকেও মরতে হবে। ওষুধ এমন একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নাম যে, এমন মানুষও রয়েছে, যার এক বেলা ভাত না খেলেও কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু ওষুধ না খেলে চলে না। প্রতিদিন খরচের একটি অংশ এবং মাসের একটি বড় অংশই চলে যায় ওষুধ কেনার খাতায়।
যে সরল বিশ^াসে আমরা ভালো থাকার জন্য এই খরচ করছি, সেই ওষুধ খেয়ে ভালো হওয়ার বদলে অনেকে অসুস্থ হচ্ছেন। কারণ তিনি তো আর জানেন না যে, তার বিশ^াস করে কেনা সেই ওষুধই আসল না ভেজাল বা নকল। একশ্রেণির অসাধু এবং ভেজাল মানুষ এই জঘন্য কাজ নির্দ্বিধায় করে যাচ্ছে। মানুষের শেষ ভরসা ওষুধেরও ভেজাল বের করে ফেলেছে। কে সেটা খাচ্ছে আর কে খাচ্ছে না সেটাই বা কে জানে! সারা বছরই অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হন। ওষুধেও যারা এই অপকর্ম করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এরা নিজেদের এত নিচে নামিয়ে এনেছেন যে শুধু ঘৃণাটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে। মানুষের জীবন এদের কাছে কোনো বিষয় না, খুব তুচ্ছ! সেই নকল ওষুধ তার আত্মীয়-স্বজনদেরও খেতে হচ্ছে। কিন্তু সেই মূর্খরা সেটাই বুঝতে পারছে না।
একাধিক চক্র মিলে এই নকল ওষুধের কাজটি করে যাচ্ছে। ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ খেয়ে রোগ সেরে ওঠার পরিবর্তে রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসা কিছু অসাধু মানুষের হাত ধরে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা এখন মাত্রা অতিক্রম করেছে। যেসব ওষুধ আসল নয় বা সঠিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি নয়, সেটাই ভেজাল বা নকল ওষুধ। যে ওষুধ সঠিক কাঁচামাল ছাড়া, মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তৈরি করা হয়, সেটাই হলো নকল ওষুধ। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তিন ধরনের গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ১৮৯টি নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোর মান পরীক্ষা করা হয়।
শুধু ঢাকা শহরে বিক্রি হওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ ওষুধই নকল, ভেজাল এবং নি¤œমানের। ঢাকার বাইরে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়েটিকের তিন ধরনের ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকা থেকে প্রায় দ্বিগুণÑ অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশের মতো নকল, ভেজাল এবং নি¤œমানের ওষুধ পেয়েছেন গবেষকরা। অনেক ক্ষেত্রে আটা, ময়দা দিয়ে বানানো ওষুধ বিক্রির ঘটনাও দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে গ্রহণ করতে হয় এমন ওষুধই নকলের টার্গেট। গ্যাসস্ট্রিকের ওষুধের অনেক নকল ওষুধ বাজারে চলছে। আমাদের তো দেখে বোঝার উপায় নেই, কোন দিক থেকে ওষুধটি নকল! যিনি ওষুধটি বিক্রি করছেন, তিনিই কেবল এই সূক্ষ্ম কারসাজি জানে! সবটাই লাভÑ এই আশায় রাখছেন নকল ওষুধ। সঙ্গে আছে অপারেশনে নিয়মিত ব্যবহার হয় এমন ওষুধ, যার দাম একটু বেশি। এসব ওষুধ বাজারজাত হয়ে চলে যায় ভোক্তার পেটে। যারা এর ভোক্তা তাদের ধরার উপায় নেই যে এটি জাল না আসল। কারণ এত সূক্ষ্ম কাজ করা হয় যে তা ধরা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ভেজাল দিয়ে তিলে তিলে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, যারা তারা সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করছে।
বিলাসবহুল অট্টালিকা করছে। ভেজাল ওষুধের সাথে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়িত আছে। এটা এমন এক চক্র, যেখান থেকে সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্যা হলোÑ আমরা যারা রোগী, তারা ওষুধের তেমন কিছুই বুঝতে পারি না। নাম দেখে ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরে সরল বিশ^াসে খেতে আরম্ভ করি। আবার যারা লেখাপড়া কেউ জানে না বা স্বল্প শিক্ষিত, তারা তো মুখে মুখে বলেই ওষুধ কিনে খেয়ে নেন। ওষুধের দোকানদারই তাদের ভরসা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সম্প্রতি নকল ওষুধের এই ভয়ংকর চিত্র বেরিয়ে এসেছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব নকল ওষুধ খেয়ে উল্টো কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র এবং শ^াসতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বলে জানা গেছে। কেন ভেজাল দেয় বা নকল ওষুধ তৈরি করে? শুধু লাভ আর লোভের বশবর্তী হয়েই তারা এই কাজটি করছে সন্দেহ নেই।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওষুধশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এক তথ্যে জানা যায়, শতকরা ৯৮ ভাগ ওষুধ দেশে উৎপন্ন হয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে। অর্থাৎ একটি বিপুল সম্ভাবনার খাত এই শিল্প। মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসা কুড়ানোর পাশাপাশি ২০১৮ সালে ‘মেডিসিন প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ পদকে ভূষিত হয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অথচ কিছু অসাধু মানুষের লোভের কারণে দুর্নাম কুড়াতে হচ্ছে। এক তথ্যে দেখা যায়, বিশ্বের উৎপাদিত প্রায় ১৫ শতাংশ ওষুধে ভেজাল রয়েছে।
যার মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে ভেজাল ওষুধের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভেজাল ও নকল ওষুধের পরিসংখ্যান বেশি। দেশ নিয়ে একটা বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। সেটা হলোÑ দেশ তোমাকে কী দিয়েছে সেটা বড় কথা নয়, তুমি দেশকে কী দিতে পেরেছ সেটাই বড় কথা। আমরা বেশির ভাগই নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থাকি।
প্রতিদিন খাদ্যপণ্যে ভেজাল মিশিয়ে মোটা টাকা লাভ করে একদিকে এসব ব্যবসায়ীরা বাড়ি-গাড়ির মালিক ও সমাজের হর্তাকর্তা বনে যাচ্ছেন, অন্যদিকে যারা এসব পণ্য খাচ্ছে, তারা নিত্য অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়ে মরছেন। তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। এর থেকে মুক্তির উপায় সহজ নয়। লাভের লোভ ত্যাগ করা অতটা সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় নিজেদের প্রতি একটু সততা। আমরা জানি, কোনটি আমাদের করা উচিত আর কোনটি করা উচিত নয় । দেশপ্রেম অন্তরের বিষয়। ভেতরে দেশপ্রেম না থাকলে এই লোভ ত্যাগ করা অসম্ভব।
নকল ওষুধ পণ্য বা ভেজাল পণ্যে কেবলই বিশ^াস কাজ করে। মানুষের বিশ^াস। আর এই বিশ^াস পুঁজি করেই এসব ভেজাল কারবারিরা মোটা টাকার মালিক হয়ে যান। এত এত টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু তার ভেজাল কারবার বন্ধ করছেন না। কেউ মানুষকে হত্যা করছে অস্ত্র দিয়ে আর কেউ বা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে তিলে তিলে! মানুষকে অসুস্থ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার ফলে সংসারে বেড়ে যাচ্ছে চিকিৎসা-ব্যয়। একটি সুস্থ জীবনযাপনের বাঁচার যে অধিকার রয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত করছে এসব নকল মানুষ। তাদের শাস্তি এমন হতে হবে, যাতে অন্য কেউ এই কাজ করতে সাহস না পায়। অন্যকে যারা বিষ খাইয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তারা কঠিনতম শাস্তির হাত থেকে যেন রেহাই না পায়।
চীনে ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশালে মৃত্যুদ-ের বিধান আছে। ঔষধ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০২২-এ ‘ঔষধ’-এর সঙ্গে ‘কসমেটিকস’ শব্দটিও যোগ করা হয়েছে। আইনটি এখন থেকে ‘ঔষধ এবং কসমেটিকস আইন-২০২২’ নামে পাস হয়েছে। মুনাফার জন্য যারা জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তির ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। ওষুধ প্রশাসনকে বিস্তৃত করতে হবে। মানুষ যাতে মেয়াদ দেখে ওষুধ কেনে, সেই সচেতনতা জাগাতে হবে। যারা ভেজাল ওষুধ তৈরি কওে, তাদের গ্রেপ্তার করে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হোক। তাহলে হয়তো এসব অপরাধ কমে আসবে। এ ছাড়া নকল ওষুধ বাজারজাত বন্ধ না করতে পারলে দেশের সম্ভাবনাময় ওষুধশিল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হতে হবে।
অলোক আচার্য
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন