‘ভাসতে ভাসতে যদি কিছু হাতে পাই, দেহি হেইয়া ধইরা বাঁচতে পারি কিনা’ এমন করুণ আকুতি ছিল সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া তিন জেলের। সঙ্গীরা তখনো বয়ার সঙ্গে ভেসে আছেন। কিন্তু কবির শিয়ালী, সোহাগ মিয়া ও গোপাল চন্দ্র মিস্ত্রী তখন শরীরের শক্তি হারিয়ে দিশেহারা। আশ্রয়হীন, জলমগ্ন সাগরের বুকে তারা অপেক্ষা করছেন হয়তো এক অলৌকিক উদ্ধারের, নয়তো মৃত্যুর। চার দিনের প্রাণান্তকর সংগ্রাম শেষে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গোপসাগর থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় এই তিন জেলেকে।
ট্রলার ডুবে যাওয়ার পর প্রথম তিনদিন ১২ জন জেলে রিং বয়া ও ফ্লুট আঁকড়ে ভেসে ছিলেন একসঙ্গে। এরপর শারীরিক দুর্বলতা ও স্রোতের তোড়ে তিনজন জেলে সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। ‘ভাই, মোগো ছাইড়া দেন’ এই কথাগুলো বলে সাগরের অতল জলে ভেসে যান তারা। সেই তিন জেলেকে পরে ভিন্ন একটি ট্রলারের জেলেরা সাগরের বুক থেকে জীবিত উদ্ধার করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে বাকিদের মধ্যে ৯ জন জেলে ভাসতে ভাসতে ভোলা উপকূলে চলে আসেন এবং সেখান থেকে রাঙ্গাবালীর সোনারচর সংলগ্ন সমুদ্র উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়া জেলেরা জানায়, চার দিন তাঁরা ছিলেন খাবার ও বিশুদ্ধ পানি ছাড়া। লবণ পানি খেয়ে, ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, শুধু বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা লড়েছেন। ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতা মনে করে আজও তারা শিউরে ওঠেন।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের পশ্চিম মঠেরখাল এলাকার আলমগীর খলিফার মালিকানাধীন ‘এফবি সাইকূল’ ট্রলারটি ৫ জুলাই গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যায়। পরদিন ৬ জুলাই ভোরে সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি ডুবে যায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে শেষ পর্যন্ত জীবিত উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন, কবির হোসেন (৫২), এবাদত (৩৬), আল-আমিন সিকদার (২৮), জাহিদ (২৭), রাসেল (২৪), ইব্রাহিম খান (৪০), মুনসুর (২৮), শাহ আলম (৬২), নূরুল হক (৪৫)। ১২ ঘণ্টা পর পাওয়া তিনজন হলেন, কবির শিয়ালী (৪০), সোহাগ মিয়া (৩৮) ও গোপাল চন্দ্র মিস্ত্রী (৪০)।
রাঙ্গাবালী নৌপুলিশ ইনচার্জ শহীদুল ইসলাম জানান, উদ্ধার হওয়া জেলেদের স্থানীয় বাজারে এনে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ট্রলার মালিক আলমগীর খলিফা জানান, ‘উদ্ধার হওয়া জেলেরা এখনও সুস্থ হয়ে ওঠেননি। চিকিৎসার পর তারা বাড়ি ফিরছে।’
উপকূল বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘প্রায়ই ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে জেলেদের উদ্ধারে কোনো স্থায়ী ব্যবস্থাপনা নেই। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি, সমুদ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে হেলিকপ্টারসহ জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা চালু করা হোক।’
আপনার মতামত লিখুন :