অনাহারে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে গাজা উপত্যকার অবুঝ শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষ। প্রতিদিনই প্রাণহানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পারা অসহায় ফিলিস্তিনি। যার মধ্যে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। কখনো কি কান্নাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে? গাজার দিকে তাকালে এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খায় মানুষের হৃদয়ের গভীরে। যেন গোটা পৃথিবী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ধ্বংসের রক্তরঙ আকাশে ছড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রতিদিনের মতো গতকালও ইসরায়েলি বর্বরতায় নিভে গেছে আরও ৩৭ ফিলিস্তিনির প্রাণ। শনিবার (২৩ আগস্ট) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, অনাহারে ও অপুষ্টিতে নতুন করে দুজন মারা গেছেন, যার মধ্যে চার শিশুও রয়েছে। এর ফলে দুর্ভিক্ষ-সম্পর্কিত মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ২৭৩ হয়েছে, যার মধ্যে ১১২ জন শিশু। মন্ত্রণালয় বলেছে, অনেকেই এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে বা রাস্তায় আটকা পড়ে আছে। তারা আরও উল্লেখ করেছে, ইসরায়েলি বোমা হামলা ও সরঞ্জামের অভাবে উদ্ধারকারী দলগুলো তাদের কাছে পৌঁছতে পারছে না।
আলজাজিরার এক ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ইসরায়েলি কোয়াডকপ্টার শেখ রাদওয়ানের একটি স্কুল ভবনের ওপর উড়ছে, যেখানে আশপাশের বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন হয়ে দেখছেন। এরপর কোয়াডকপ্টারটি লক্ষ্যবস্তুতে একটি বিস্ফোরক ফেললে অন্তত ১২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ওই স্কুলে অনেক ফিলিস্তিনি তাদের অস্থায়ী তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছিল। এদিকে ইসরায়েলি বাহিনী মানবিক সহায়তা নিতে আসা বেসামরিক নাগরিকদের ওপরও হামলা অব্যাহত রেখেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এমন হামলায় ২৪ জন নিহত এবং ১৩৩ জন আহত হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের মতে, ২৭ মে থেকে মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে ২ হাজার ৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১৫ হাজার ১৯৭ জন আহত হয়েছে। এর আগে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, হামাস যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইসরায়েলের শর্তে সম্মত না হলে গাজার বৃহত্তম শহরটি ধ্বংস করে দেওয়া হবে। গত মার্চের শুরু থেকে ইসরায়েলের পূর্ণ অবরোধ গাজার ২৪ লাখ বাসিন্দার জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যার ফলে দুর্ভিক্ষ, রোগ-ব্যাধি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং জরুরি পরিষেবাগুলোর বিপর্যয় ঘটছে।
গাজার দুর্ভিক্ষে বাসিন্দারা ভয়াবহ ক্ষুধার সম্মুখীন। রিম তৌফিক খাদার তাদের মধ্যে অন্যতম। পাঁচ সন্তান নিয়ে উপত্যকাটিতে বসবাস করছেন তিনি। করুণ দুর্দশার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গত পাঁচ মাসে আমরা কোনো আমিষ খাইনি। আমার চার বছরের ছেলে জানে না ফলমূল বা সবজি দেখতে বা খেতে কেমন।’ গাজার দুর্ভিক্ষে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্ভিক্ষের ঘোষণা অনেক দেরিতে এলেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
জাতিসংঘ সমর্থিত প্রতিবেদন বলছে, গাজায় সহায়তা প্রবেশে ব্যাপকভাবে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। তবে তেল আবিব এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গাজাজুড়ে ক্ষুধা ও অনাহারের পরিস্থিতি অভিজ্ঞ প্রত্যক্ষদর্শী, মানবিক সংস্থা ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার জাতিসংঘ সমর্থিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি প্রথমবারের মতো বলেছে, গাজা সিটি ও আশপাশের এলাকায় ‘সম্পূর্ণভাবে মানব সৃষ্ট’ দুর্ভিক্ষ চলছে।
গাজায় দুর্ভিক্ষ নিয়ে সাম্প্রতিক ঘোষণাকে ‘অবাক করার মতো কিছু নয়’ উল্লেখ করে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন সেভ দ্য চিলড্রেনের সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার শাইমা আল-ওবাইদি। তিনি বলেন, ‘গাজার শিশুরা আমাকে বলেছে, তারা চায় যেন মারা যায়, যাতে স্বর্গে গিয়ে অন্তত খেতে পারে।’ শাইমা জানান, গত ২ মার্চ রমজান মাসে তিনি গাজায় ছিলেন। সে সময় হঠাৎ করেই ত্রাণপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ‘সেদিন গাজায় খানিক আনন্দ ছিল, কারণ বাজারে বহুদিন পর লেটুসপাতা পাওয়া গিয়েছিল। মানুষ আলোচনা করছিলেন, ইফতারে সালাদ বানানো যাবে কি না।
কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই প্রোটিন ও মাংস ফুরিয়ে যায়, সপ্তাহখানেকের মধ্যে তাজা ফল-সবজি বন্ধ হয়ে যায়। এক মাসের মধ্যেই ময়দাও শেষ হয়ে যায়, আর যা মেলে তার দাম হয়ে যায় স্বাভাবিকের তিন গুণ।’ তিনি বলেন, মানুষ তখন ঘাস ও গাছের পাতা খেতে শুরু করে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিল শিশুদের আর্তনাদÑ ‘তারা বলেছে, মৃত্যু হলে অন্তত জান্নাতে খাবার পাওয়া যাবে।’
শাইমা সতর্ক করেন, এই ধারা চলতে থাকলে গাজা দ্রুত মানবশূন্য হয়ে পড়বে। তার মতে, এ অবস্থার জন্য শুধু হামাস বা ইসরায়েল নয়, বরং সব রাষ্ট্রই দায়ী, যারা নীরব থেকে এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানায়নি। ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে আরও ৭১ জন নিহত হয়েছে। একই সময় ২৫১ জন আহত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এখনো অজানা।