চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মধ্যম কাঞ্চন নগরে শিশির ভেজা সকাল যেন আজও কাঁদছে। তালুকদার বাড়ির পাশের চায়ের দোকানে জড়ো হয়েছে মানুষ, মুখে একটাই প্রশ্ন- মাত্র ১৫ বছরের ছেলেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো অপরাধ কী ছিল তার? মা খাদিজার কোলজুড়ে আজ সন্তান নেই, আছে শুধু কান্না। বাবার দোকান আর ভাঙা হৃদয়ে বেঁচে আছে রিহান- যে ফিরে এসেছিল কক্সবাজার ঘুরে, কিন্তু ফিরতে পারেনি নিজের জীবনে।
খাদিজার কান্না থামছে না, ‘আমার রিহান শেষ মুহূর্তে একটু পানি চাইছিল, তাও দিতে দেয় নাই তারা। আমর সামনে পিটাই পিটাই মারছে।’
রিহান, মাত্র ১৫ বছর বয়স। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। মায়ের চোখের মণি, বাবার চায়ের দোকানের ছোট্ট সহকারী। গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার থেকে ঘুরে ফিরছিল সে ও তার দুই বন্ধু রাহাত ও মানিক। কিন্তু শুক্রবার ভোরে বাড়ি ফেরার পথে শুরু হয় বিভীষিকাময় অধ্যায়।
ভোর ৪টার দিকে তিন কিশোর একটি অটোরিকশায় চায়ের দোকানের পাশে নামে। হঠাৎ ‘চোর চোর’ বলে ছুটে আসে সাত-আটজন লাঠিসোঁটা হাতে যুবক। বাঁচতে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় একটি দোতলা নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদে। সেখান থেকে ধরে এনে চেইঙ্গা সেতুর ওপর তিনজনকে বেঁধে মারধর করা হয়। রিহান মারা যায় ঘটনাস্থলেই। বাকি দুই কিশোর এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
রিহানের মা বলছেন, ‘ওর জন্মের আগে তিনটা সন্তান মারা গেছিল। এরপর রিহান আসছিল আমার জীবনে আলো হয়ে। হাফেজ বানাইতাম, মানুষ বানাইতাম। সেই ছেলেকেই তারা পিটাই পিটাই মাইরা ফেলল!’
ঘটনার আসল কারণ নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন। স্থানীয়রা বলছেন, ভিন্ন এলাকার ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল বলেই রিহানদের ‘চোর’ সাজিয়ে পেটানো হয়। মা খাদিজাও একই দাবি করছেন- ‘শুধু সেই কারণে! আমি কিছু চাই না, শুধু ফাঁসি চাই ওদের।’
নিহতের পরিবার পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে। দুজন- মুহাম্মদ নোমান ও মুহাম্মদ আজাদ- পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। বাকি তিনজন পলাতক।
পুলিশ ধারণা করছে, এটি পূর্ব বিরোধের জের। শুধু চুরির সন্দেহে নয়, বরং সম্পর্কবিরোধ থেকে সাজানো হয়েছে ‘চোর নাটক’।
রিহানের বাবার কণ্ঠেও অসীম যন্ত্রণা- ‘ওরা এখন বলছে টাকা দেব, মামলা না করো। আমি ছেলে বিক্রি করব না, বিচার চাই।’
গ্রাম এখন স্তব্ধ। রিহানের ঘরের খাটে পড়ে আছে তার স্কুলব্যাগ, বই আর স্কুল ড্রেস। আর সেই মায়ের হাতে এখনো বাঁধা রিহানের শেষ উপহার- এক জোড়া রঙিন চুড়ি।