গাজায় বাসিন্দাদের করুণ বাস্তবতা। তাদের জীবনের প্রতি মোড়েই মৃত্যু ওঁৎ পেতে আছে। ঘরে বাইরে সর্বত্র মৃত্যুদূতের আনাগোনা। এটাই এখানকার এর সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে চলতে হচ্ছে। গাজায় এখন মৃত্যুর অনেক পথ, তবে তা বেছে নেওয়ার মতো সুযোগ আমাদের কারো নেই। যে কেউ বোমায় মারা যেতে পারে। গাজাবাসীর জন্য এখন মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোও প্রাণঘাতি হয়ে উঠেছে। পানি এর মধ্যে অন্যতম। পানি সংগ্রহ, পান করা, সাঁতার কাটা, সরবরাহ ব্যবস্থা, সাগরে মাছ ধরাÑ যেকোনো কিছুই গাজাবাসীর জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। গাজায় গণহত্যার শুরু থেকে এ উপত্যকার পানি সরবরাহের অবকাঠামো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়মিত হামলার লক্ষ্যে পরিণত করেছে। ইতোমধ্যে গাজার পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামোর ৮৫ ভাগই অকার্যকর করে দিয়েছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে পাইপলাইন, কূপ, পরিশোধন কেন্দ্র। পানিসংক্রান্ত যেকোনো সামগ্রী এ উপত্যকায় প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এসব অবকাঠামো মেরামতও করা যাচ্ছে না। শুধু প্রবেশ আটকানোই নয়, গাজার পানিসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের ওয়্যারহাউসেও হামলা করেছে ইসরায়েল। ধ্বংস হয়ে গেছে সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, পানি সরবরাহ অবকাঠামোর কর্মী বা যারা পানি পান করতে হয়। ফলে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ছড়াচ্ছে। প্রাণহানি বাড়াচ্ছে গাজায়।
সম্প্রতি আমি নিজেও হেপাটাইটিস এ-তে আক্রান্ত হই। পেটে একটানা ব্যথা নিয়ে একটি ক্লিনিকে গেলে শুধু পেইন কিলার লিখে দিয়ে শুভ কামনা জানানো হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাভাবিক চাহিদা পূরণে একজন মানুষের দিনে ১০০ লিটার (২৬ গ্যালন) পানি প্রয়োজন। গাজার মানুষ এখন দিনে পাচ্ছে দুই থেকে ৯ লিটার (০.৫-২.৩ গ্যালন)। পানি নিয়ে এ সংগ্রাম গাজাবাসীর প্রতিদিনের অসংখ্য লড়াইয়ের একটি অংশ মাত্র। আমি বুঝতে পারি না, এই ২১ শতকেও কীভাবে আমাদের এ রকম মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। যেখানে প্রতিদিনই বিশ্ব নেতারা মানবাধিকার, আইনের শাসন ও মানবজাতির অগ্রগতির কথা বলছেন। গত ডিসেম্বরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশ্যেই বলেছে, গাজায় গণহত্যা চলছে। পানি থেকে গাজাবাসীকে বঞ্চিত করাকে পরিকল্পিত বলেও মন্তব্য করেছে তারা। ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত হাজারো গাজাবাসী পানিশূন্যতা, অপুষ্টি ও নানা রোগে মারা গেছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এরপর এক বছর কেটে গেছে। ইসরায়েলিরা পানিকে একটি মারণাস্ত্রে পরিণত করায় গাজা উপত্যকায় অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এগুলো ঠিকই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবু বিশ্ব নির্বিকার, ইসরায়েলকে ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপই দেখা যাচ্ছে না।
যুদ্ধবিরতির মধ্যেই ফিলিস্তিনির গাজায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত রয়েছে। আগের মতো প্রাণহানি না ঘটলেও গাজার বাসিন্দারা জীবন নিয়ে সর্বদা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার পুনর্গঠন নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলে গাজার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে দূষণ। বাসিন্দারা দূষিত পানি খেতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় নিরাপদ খাবার পানির উৎস দূষিত হয়ে পড়ছে। গাজার ক্রমবর্ধমান দূষণ বাসিন্দাদের ভয়ানক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় এবারের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগেই এ নিয়ে কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্রাজিলে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম আল-জেবেন বলেছেন, গাজার জনস্বাস্থ্য এখন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। ফলে উপত্যকায় পরিবেশগত অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ইসরায়েলের হামলায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ৬১ মিলিয়ন টন ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে। এতে কিছু বিপজ্জনক পদার্থ রয়েছে, যা পরিবেশ দূষিত করছে। এ ছাড়াও পয়ঃনিষ্কাশন এবং পানি ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ ও উপকূলীয় পানির উৎস দূষিত হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের হামলায় উপত্যকার কৃষিজমির বেশির ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে বাসিন্দারা এখন মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ত্রাণ সরবরাহ এখনো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল।
গাজার ওপর ইসরায়েলের যুদ্ধ কেবল পুরো এলাকা ধ্বংস করেনি, পরিবারগুলোকে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত করেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে চিকিৎসাব্যবস্থা। ফিলিস্তিনিরা যে মাটি ও পানির ওপর নির্ভর করে তাও বিষাক্ত হয়ে গেছে। চার সপ্তাহ ধরে চলা ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির মধ্যে পরিবেশগত ধ্বংসের মাত্রা বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। পাইপলাইন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। বেশির ভাগ জলাশয়ে দূষণ বেড়েছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের পানীয় জলের দূষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ধ্বংসস্তূপ সরানোর সরঞ্জাম এবং ভারী যন্ত্রপাতির অভাবের কারণে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
ইসরায়েল গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে। শনিবার মধ্য গাজার বুরেজে হামলায় এক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হাসপাতাল সূত্র আলজাজিরাকে জানিয়েছে, সেখানে শরণার্থী শিবিরে সেনাবাহিনী গুলি করে তাকে হত্যা করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উদ্ধারকারীরা আগের হামলায় নিহত ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে। অক্টোবর মাসে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা কমপক্ষে ২৬৪টি আক্রমণ চালায়, যা ২০০৬ সালের পর থেকে এক মাসে সর্বোচ্চ আক্রমণ।
গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে হামলায় নিহতের সংখ্যা ২৪১ জনে দাঁড়িয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৬১৪ জন। গত দুই বছরে হামলায় অন্তত ৬৯ হাজার ১৬৯ জন নিহত ও ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৮৫ জন আহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রেডক্রসের মাধ্যমে ইসরায়েল থেকে আরও ১৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এর ফলে যুদ্ধবিরতির সময় পাওয়া মৃতদের মোট সংখ্যা ৩০০ জনে দাঁড়িয়েছে। মরদেহগুলোর মাত্র ৮৯ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব মৃতদেহে নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। অপরদিকে সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদ সর্বশেষ একজন ইসরায়েলি সৈনিকের মরদেহ ইসরায়েলের কাছে ফেরত দিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, এখনও পাঁচজন বন্দির মৃতদেহ ফেরত পাঠানো বাকি আছে। অন্যদিকে দক্ষিণ লেবাননে নতুন ইসরায়েলি হামলায় ২ জন নিহত হয়েছেন। হামলা অব্যাহত রয়েছে। লেবাননের জাতীয় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব লেবাননের আইন আতা এবং শেবা শহরের মধ্যে একটি গাড়ি লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বিমান হামলায় দুই ভাই নিহত হন।
ফিলিস্তিনি কর্তৃৃক গাজা থেকে ফেরত পাঠানো সর্বশেষ জিম্মির দেহাবশেষ শনিবার শনাক্ত করেছে ইসরায়েল। মার্কিন মধ্যস্থতায় দুই বছরের যুদ্ধ থামানোর ফলে যুদ্ধবিরতির অধীনে আরও পাঁচটি মৃতদেহ ফেরত পাঠানো এখনো বাকি রয়েছে। খবর বার্তা সংস্থা এএফপি’র। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী শুক্রবার ফেরত পাওয়া মৃতদেহটি স্বেচ্ছাসেবক অ্যাম্বুলেন্স চালক লিওর রুদাফের বলে শনাক্ত করেছে। রুদাফ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহত হন যা গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। রক্তাক্ত আন্তঃসীমান্ত হামলার সময় আর্জেন্টিনার ইসরায়েলি এই ব্যক্তির বয়স ছিল ৬১ বছর। তার সম্প্রদায় নির ইতজাক কিবুতজকে রক্ষা করার চেষ্টার সময় নিহত পাঁচ সশস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তির মধ্যে তিনি একজন। ২০২৪ সালের মে মাসে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।

