জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বিনিয়োগ কোনো খরচ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় সুযোগ বলে নতুন এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় ‘রিটার্নস অন রেজিলিয়েন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সিস্টেমিকের নেতৃত্বে ২০টি সংগঠনের জোট।
এতে বলা হয়েছে, অভিযোজন খাতে প্রতি ১ ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে ১০ ডলার সমান সুফল পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু বিপন্ন দেশগুলোতে অভিযোজন খাতে এখনই পরিকল্পিত বিনিয়োগ করা গেলে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক মন্দা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। প্রতিবেদনটি বলছে, জলবায়ু সহনশীলতায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ২৮ কোটি নতুন কর্মসংস্থান হতে পারে। একই সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতের বার্ষিক বৈশ্বিক বাজার ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘জলবায়ু সহনশীলতায় বিনিয়োগ মানে ঝড়, তাপপ্রবাহ এবং বন্যার মতো দুর্যোগের মুখে থাকা মানুষ ও তাদের জীবিকা রক্ষা করা। এটি একটি জরুরি অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তাও। সহনশীলতা নির্মাণ নিশ্চিত করে যে কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত উন্নয়ন যেন ধ্বংস না হয়। এটি বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান যে, সহনশীলতা ও অভিযোজনকে আমাদের সময়ের বিনিয়োগ এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।’
বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সম্ভাবনা:
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু সহনশীলতার জন্য বাংলাদেশ আগে থেকে যেসব খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে বৈশ্বিকভাবে সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও খরা সহনশীল, লবণাক্ততা সহনশীল ফসল, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা বাঁধ, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামো।
এর পরও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা এবং বন্যার মতো দুর্যোগে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর চরম আবহাওয়াজনিত ক্ষতি ধনী দেশগুলোর তুলনায় ১০ গুণ বেশি এবং ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চার গুণ বেশি সময় লাগে।
যদি বর্তমান অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জিডিপি ১৮ থেকে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বিশেষ করে কৃষি, মৎস্য ও উপকূলভিত্তিক বাংলাদেশের মতো দেশে এই ক্ষতির প্রভাব হবে ভয়াবহ।
জলবায়ু সহনশীলতায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি, নির্মাণ ও অবকাঠামো খাতে লাখো চাকরির সুযোগ তৈরি হতে পারে। অভিযোজন কার্যক্রম বাড়ালে ২০৫০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। বৈদেশিক ঋণ খরচ কমবে। এ ছাড়া পানি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন খাতে কার্যকর উদ্যোগ নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ২০ লাখ অকালমৃত্যু এড়ানো সম্ভব, যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত।
অর্থায়নের ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ:
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক জলবায়ু সহনশীলতা অর্জন করতে হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে বর্তমানে এই খাতে অর্থায়ন মাত্র ৫৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে ২৯৬ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়ে গেছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, প্রতি ১ ডলার সহনশীলতায় বিনিয়োগের বিপরীতে ৮৭ ডলার ব্যয় হচ্ছে এমন সব খাতে, যেখানে জলবায়ু ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বান কি-মুন ছাড়াও প্রতিবেদনে নেতা, ব্যবসায়ী, জ¦ালানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত দিয়েছেন। তারা সবাই জলবায়ু সহনশীলতা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু উপদেষ্টা ও ব্রিজটাউন ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ড. পেপ বারডুইল বলেন, ‘সহনশীলতা হলো সমৃদ্ধির ভিত্তি, তবু এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে অবমূল্যায়িত বিনিয়োগ। আমাদের বিনিয়োগ নীতিগুলো এখনো এই খাতকে বাধাগ্রস্ত করছে। কপ৩০ হতে হবে মোড়ের বিন্দুÑ নিয়মগুলো পুনর্লিখন করতে, সহনশীলতার প্রকৃত ফলাফল স্বীকৃতি দিতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের সুযোগ খুলে দিতে।