জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ঘিরে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে এরই মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গণভোট আয়োজনের প্রয়োজনীয়তায় একমত হলেও কার্যকর বাস্তবায়ন ও সময়সীমা নিয়ে বিভিন্ন মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো সনদে স্বাক্ষর না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
আর তিন শর্ত পূরণ না হলে এনসিপিও স্বাক্ষর করবে না। আর বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর মধ্যে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও জাতীয় নির্বাচনের আগে, নাকি একই সঙ্গে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান ঘনীভূত হয়েছে। এমন বাস্তবতায় আজ শুক্রবার স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে ঐতিহাসিক জুলাই জাতীয় সনদ।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক ঐকমত্য, ভিন্নমতের সমন্বয়, প্রশাসনিক প্রস্তুতি, ভোটার সচেতনতা এবং স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ সবই একত্রে সফল বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। আজ শুক্রবার সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক রূপ পাবে, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আজ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপনে কমিশনের মেয়াদ তৃতীয় দফায় ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এতে রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, সনদ স্বাক্ষরের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত না-ও হতে পারে। এই বর্ধিত সময়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবে।
এদিকে বহুল আকাক্সিক্ষত ‘জাতীয় জুলাই সনদ, ২০২৫’-এ কোনো রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর না করলে পরেও করতে পারবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। গতকাল বৃহস্পতিবার সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, সনদ বাস্তবায়নের জন্য কমিশন সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ উপস্থাপন করবে। কমিশনের মেয়াদের মধ্যেই সরকার সনদ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে বলেও আশা করেন তিনি।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘প্রতিটি দল, রাজনৈতিক শক্তি ও নাগরিকদের আহ্বান জানাচ্ছিÑ আপনারা সবাই আসুন। আগামীকালের (আজকের) অনুষ্ঠান উৎসবমুখর হবে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। অঙ্গীকারের পাতায় প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করবে, এরপর কমিশনের সদস্য এবং সবশেষে প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করবেন।’
জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, কমিশন মনে করে এটি অবশ্যকরণীয়। আমাদের সুপারিশে সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা অপেক্ষায় আছি, শুক্রবার সবাই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সনদে স্বাক্ষর করবেন। মতভিন্নতা সত্ত্বেও সবাই অংশ নেবেন বলে আশা করি।’
তিনি আরও আশা প্রকাশ করেন, এনসিপি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে স্বাক্ষর করবে এবং বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
স্বাক্ষরের সময়সূচি প্রসঙ্গে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘আমরা চাই কালকেই (আজ) সবাই স্বাক্ষর করুন। তবে কোনো রাজনৈতিক দল যদি পরে স্বাক্ষর করতে চায়, সেটাও করতে পারবে।’
এই আয়োজনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত থাকবেন। সেই সঙ্গে এই আয়োজনে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা ও উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আজ বিকেল ৪টায় এটি অনুষ্ঠিত হবে।
এই অনুষ্ঠানে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অনুষ্ঠান এলাকায় ড্রোন ওড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ছাত্রজনতার আন্দোলনের পেক্ষাপটে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পেক্ষাপটে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা কাটাতে গত বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘অতি জরুরি’ বৈঠক ডাকেন।
বৈঠকে অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং অন্যান্য ছোট-বড় রাজনৈতিক দল। তবে বৈঠকের পরেও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান নানা কারণে অনড় থাকার ফলে সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে নির্ধারিত হয়নি।
বৈঠকে বিএনপি জানিয়েছে, তাদের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) থাকলে সনদে সই করবে। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি সরকারকে সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছে। জামায়াত বলেছে, তারা সরকারের সম্মানে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবে, তবে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত পরে জানাবে।
এনসিপি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, বাস্তবায়নের পথ সুস্পষ্ট না হলে তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। কয়েকটি বাম ও ছোট দল ছাড়াও অন্যান্য দল সক্রিয়ভাবে সনদে সই করতে আগ্রহী।
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আজ শুক্রবার সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। এই প্রস্তুতি তদারকি করছেন প্রধান উপদেষ্টা, যিনি ইতালি সফর শেষে দেশে ফেরেন এবং দুপুরে যমুনা হোটেলে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।
এ বৈঠকের আগে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দলগুলোকে দুই ঘণ্টার নোটিশে জরুরি বৈঠকে ডাকা হয়, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনার জন্ম দেয়।
বাস্তবায়নের পদ্ধতি: প্রধান দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু
জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার অন্তর্ভুক্তি রয়েছে, যা ছয়টি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে নেওয়া হয়। সনদে উল্লেখিত সাত দফা অঙ্গীকার এবং পটভূমি থাকা সত্ত্বেও সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, তারা সরকারকে সুপারিশ দেবে যে গণভোট এবং অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে সনদ কার্যকর হবে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনের দিন গণভোট চায়, যেখানে জামায়াত ও এনসিপি আগে গণভোট আয়োজনের পক্ষে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে, যা জাতীয় ঐক্যের ফলস্বরূপ নির্ধারিত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বৈঠকে বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে একটি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। নোট অব ডিসেন্ট থাকা সত্ত্বেও আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত।
তিনি আরও বলেন, সনদ বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার। বিএনপি উচ্চকক্ষে নির্বাচনের কাঠামো চায়, তবে নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী কিছু সংস্কার তারা বাস্তবায়ন করবে না।
জামায়াতের অবস্থান
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, দেশে নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা হয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে গণভোট ও সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া উচিত।
নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেব, তবে স্বাক্ষর নিশ্চিত নয়। আদেশের মাধ্যমে সনদ কার্যকর করা এবং নির্বাচনের আগে গণভোটের বিষয়ে ফয়সালা করতে হবে।
জুলাই সনদে চূড়ান্তভাবে বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। বিএনপি দাবি করছে, বর্তমান সরকার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে, যেখানে জামায়াত মনে করছে, সরকার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত।
এই ভিন্নমতের কারণে সনদে ১০৬ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হলেও কার্যকর বাস্তবায়ন নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
এনসিপি: গণভোটের দিনক্ষণ ও বাস্তবায়নের শর্ত
বাস্তবায়ন আদেশের বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়, সনদে স্বাক্ষর করার আগে সরকারের কাছ থেকে বাস্তবায়ন আদেশ এবং গণভোটের বিষয় নির্ধারণ হতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আইনি ভিত্তি ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা মানে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা। গণভোটের প্রশ্ন ও তার দিনক্ষণ আগে নির্ধারণ করতে হবে।
সেই বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা অনুষ্ঠানে অংশীদার হব না। গণভোটে রায় পেলে নোট অব ডিসেন্টের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। পরবর্তী সংসদ সংবিধান সংশোধন করবে এবং নতুন সংবিধানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ সংবিধান-২০২৬’।
এনসিপি দাবি করছে, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলোÑ ১৫ শতাংশ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচন নিশ্চিত করা, যেখানে কমিশনের প্রস্তাব মাত্র ৫ শতাংশ। এ ছাড়া, সংবিধানের স্থগিত প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডারের মাধ্যমে সনদ কার্যকর করা প্রয়োজন।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে সংশোধিত খসড়া না পেলে সনদে সই করবে না বাম ধারার চারটি দল। দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ। সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছে দলগুলো।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সফল হলে দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ সরকারকে জানানো হবে। এনসিপি সই করবে বলে আমরা আশাবাদী। তিনি আরও জানান, ৮৪টি সংস্কারের মধ্যে মাত্র একটি বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে, যা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সনদ স্বাক্ষরের বিষয়ে এনসিপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করা হবে। একই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন উইংয়ের মাধ্যমে দলটিকে বোঝানোর চেষ্টা করা হবে।
যেসব বিষয়ে একমত ও ভিন্নমত
একমত যেসব বিষয়ে:
একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দশ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন। এই প্রস্তাবে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলেও জানানো হয়েছে সনদের চূড়ান্ত খসড়ায়। ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত করার পক্ষে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বিএনপি, জামায়াতসহ ৩১টি রাজনৈতিক দল ও জোট। অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে জাতীয় সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত এনসিপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল।
বিএনপির কিছুটা মতপার্থক্য থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে ২৯টি রাজনৈতিক দল ও জোট। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি নিয়েও বিএনপি-জামায়াতসহ ২৯টি রাজনৈতিক দল ও জোট ঐকমত্যে পৌঁছেছে। ৯টি রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে সংবিধানের ধারায় পরিবর্তন আনার পক্ষে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট একমত হয়েছে বলেও জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে ঐকমত্য হয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের। জাতীয় সংসদের নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০তে উন্নীত করতে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে সনদে।
ভিন্নমত যেসব বিষয়ে:
সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিতকরণের বিষয়ে ২৯ রাজনৈতিক দল একমত হলেও ভিন্নমত জানিয়েছে গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদসহ তিনটি দল। তবে প্রধানমন্ত্রী যিনি থাকবেন তিনি দলীয় প্রধান বা সংসদপ্রধানের মতো একাধিক পদে থাকতে পারবেন না, এমন বিধানের পক্ষে ২৫টি রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছালেও এ নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপিসহ পাঁচটি রাজনৈতিক দল ও জোট। সংসদে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
সনদে দেখা গেছে, উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে জামায়াত এনসিপিসহ ২৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট একমত হলেও এতে, ভিন্নমত রয়েছে বিএনপিসহ ৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের।
দলগুলোর জন্য অঙ্গীকারনামায় যা বলা হয়েছে
রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরের জন্য যে জুলাই সনদ ২০২৫ তৈরি করা হয়েছে, তাতে দলগুলোর জন্য সাতটি অঙ্গীকারনামা প্রস্তুত করা হয়েছে।
এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে রাজনৈতিক দলগুলো।’
(২) ধারায় বলা হয়েছে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ গ্রহণ করেছি বিধায় এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে অঙ্গীকারনামার (৩) ধারাটি। এই ধারায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবে না দলগুলো। একই সঙ্গে সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
চতুর্থ দফায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
পঞ্চম দফার ঘোষণায় ‘গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহিদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও শহিদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।
ষষ্ঠ দফায় জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি-ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সহযোজন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।
আর শেষ দফায়, জুলাই জাতীয় সনদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।