আদালতের দেওয়া রায়ের পর নিলাম ডেকে ক্রেতা বা বিডার না পেয়ে গত আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশের ৭৪টি অর্থঋণ আদালতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বন্ধকি সম্পত্তি দখল সনদ নেওয়ার জন্য আবেদন রয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৪০০টি, যার সঙ্গে জড়িত প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। মূলত নিলাম ব্যর্থ হয় সাধারণত বাজারদরের চেয়ে বেশি দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছিল এমন জমির অথবা যেসব জমির পারিবারিক বা উত্তরাধিকার জটিলতা রয়েছে কিংবা সরকারের খাসজমি জড়িত থাকার কারণে। সাধারণত তিনবার নিলাম ডেকে দরদাতা বা ক্রেতা না পেলে আইন অনুযায়ী ব্যাংক ওই সম্পত্তির দখল সনদ নিতে আদালতে আবেদন করে; যা পেলে সম্পত্তি ব্যবহার, ভাড়া বা পরবর্তী সময়ে বিক্রি করতে পারে ব্যাংক।
জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দখল সনদ পেতে বিভিন্ন ব্যাংক ৪৭৬টি আবেদন করেছে ঢাকার সাতটি অর্থঋণ আদালতে। এই আবেদনগুলোর সঙ্গে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ জড়িত। ২০২৪ সালে আবেদনের সংখ্যা ছিল ৬২০টি, যার সঙ্গে জড়িত ১৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এবং ২০২৩ সালে ৫১১টি আবেদন করা হয়, যার সঙ্গে জড়িত প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশের ৭৪টি অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ৭৬ হাজার মামলা। এই মামলাগুলোর মধ্যে ঋণের বিপরীতে থাকা মর্টগেজড স্থাবর সম্পত্তি ব্যাংকের অনুকূলে দখল সনদ নেওয়ার জন্য আবেদন রয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৪০০টি। এসব আবেদনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
২০২৪ সালে ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৪ ঘোষণা করে ১২৩টি ঋণখেলাপি মামলার রায়, যার সঙ্গে জড়িত প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপী ঋণ। প্রতিটি মামলার রায়ে ঋণের বিপরীতে জামানত থাকা সম্পত্তি নিলামের মাধ্যেমে বিক্রি করে টাকা পুনরুদ্ধারে ব্যাংকের পক্ষে রায় দেওয়া হয়। এই আদালতের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১২৩টি রায় হওয়ার পর ৮১টি রায় বাস্তবায়নের জন্য নিলাম ডাকার পর বিডার না পাওয়ায় এই আদালতে ব্যাংকগুলো আবেদন করেছে জামানত থাকা সম্পত্তি নিজেদের নামে দলিল করে নেওয়ার জন্য। আর ১৭টি রায় হাইকোর্ট স্থগিত করেছে বিবাদীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। ছোটখাটো খেলাপি ঋণের আটটি রায় বাস্তবায়ন হয়েছে নিলামের মাধ্যমে। বাকি ১৭টি রায় নিয়ে ব্যাংক আর কোনো আপডেট জানায়নি বলে উল্লেখ করেন ওই কর্মকর্তা। ছোটখাটো নিলাম কখনো কখনো সফল হচ্ছে। যেমনÑ জনতা ব্যাংক একবার মাত্র ৩ লাখ টাকার ঋণ উদ্ধারে সম্পত্তি নিলামে তোলে। আরেকটা ঘটনায়, এবি ব্যাংক ২০০৬ সালে ভাটারার একটি বাড়ি বিক্রি করে আংশিক ঋণ উদ্ধার করে।
আদালতের ওই কর্মকর্তা অর্থঋণ আদালতে প্রায় ১১ বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এরকম খুব ছোটখাটো অল্প কিছু নিলাম হয় সব সময়। কিন্তু, বড় ঋণ আদায়ের বেলায় বেশির ভাগ নিলাম কার্যকর হয় না।’
এই আদালত ৬৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে পূবালী ব্যাংক শনির আখড়া শাখার অনুকূলেও রায় দেয়। কিন্তু তিন তিনবার নিলাম ডেকেও কোনো ক্রেতা না পাওয়ায় ব্যাংকের কাছে জামানত থাকা ঋণগ্রহীতার তিনটি বাড়ি ব্যাংক নিজের নামে দলিল করে নিয়েছে। আদালতে দেওয়া ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাড়িগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে একটি কোম্পানির কাছে।
ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির অধিকাংশ ঘটনায় একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমনÑ হলমার্ক গ্রুপের সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ আত্মসাতের ঘটনাও একই চিত্র তুলে ধরে। নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই ঋণগুলোর মধ্যে হলমার্ক ফ্যাশন লিমিটেডের কাছ থেকে ৫৮৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ওঠাতে আদালতের মাধ্যমে গাজীপুরে ৩ হাজার ৮৩৪ শতক জমির ভোগ ও দখলের মালিকানা পায় সোনালী ব্যাংক। হলমার্ক ফ্যাশনের এমডি তানভীর আহম্মেদ ও চেয়ারম্যান জেসমিন আক্তার সোনালী ব্যাংকের কাছ থেকে এই জমি বন্ধক দেওয়ার শর্তে ঋণ নিয়েছিলেন। সোনালী ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ওই সম্পত্তিগুলো নিয়ে এখন ব্যাংক ফেলে রেখেছে। সেখানে বাউন্ডারি দিয়ে ব্যাংকের নামে সাইনবোর্ড ঝোলানো আছে।
ওই জমি তেমন কোনো কাজে আসছে না। কয়েক বছর আগে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের খেলাপির তালিকায় নাম আসে এইচআরসি গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদ হোসেন চৌধুরীর। সাঈদ হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের এইচআরসি শিপিং লাইনসের কাছে সুদসহ ব্যাংকটির মোট পাওনা ১২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। অর্থঋণ আদালতে মামলা করে রায় পায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। তবে খেলাপি ঋণের টাকা আদায়ে বন্ধকি সম্পত্তি একাধিকবার বিক্রির চেষ্টা করেও ক্রেতা পায়নি ব্যাংকটি। পরে আদালতে আবেদন করে বন্ধকি সম্পত্তি দখলে নেয় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
এদিকে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি না হওয়ার আরেকটি বড় কারণ জমির মৌজা দরের সঙ্গে বাজারদরের অমিল। বেশির ভাগ বন্ধকি সম্পত্তি সরকার নির্ধারিত দর বা মৌজা রেট বাজারদরের তুলনায় অনেক কম। এতে সম্পত্তির নিবন্ধন প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে বিক্রি না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো বেশির ভাগ কন্ধকি সম্পত্তি সরকার নির্ধারিত দর বা মৌজা রেট বাজারদরের তুলনায় অনেক কম। যেমনÑ গুলশানে ১০ কোটি টাকা দামের একটি ফ্ল্যাটের মৌজা দর ৫০ লাখ টাকারও কম। কেউ চাইলেও মৌজা দরের বেশিতে নিবন্ধন করা জটিল। এটি সবাই দেখছে, জানছে কিন্তু কোনো সমাধানে আসছে না। এই ব্যাংকার বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পূর্ববর্তী সময়ে উচ্চমূল্যের সম্পত্তি বেচাকেনার ক্ষেত্রে অনেক রীতি-নীতিই উপেক্ষা করা হতো। কিন্তু এখন কেউ আইন ভঙ্গ করে এ ধরনের সম্পত্তি কেনার সাহস করছেন না।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণার তথ্যে বলা হয়, জামানতের সম্পদ বিক্রি করে দেশের ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের মাত্র ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ আদায় করতে পারছে। জামানত বিক্রি করে ঋণের আসল আদায় করা গেলেও আদায় হচ্ছে না সুদ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঋণের বিপরীতে স্থাবর সম্পত্তি বন্ধকির ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে একটি নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশে বেশির ভাগ ঋণের ক্ষেত্রে এই বন্ধকি সম্পত্তি নিয়ে একধরনের প্রতারণার আশ্রয় নেয় ঋণগ্রহীতা, যে প্রতাণার সঙ্গে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িত। তিনি বলেন, সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার আগে যথাযথভাবে যাচাইবাছাই করার জন্য ব্যংকগুলোকে আন্তরিক হতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, যেকোনো সম্পত্তি বন্ধকের সময় চার্জ ক্রিয়েট করতে হয়, যেটির রেগুলেটরির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু সেই বিধান প্রায়ই মানা হয় না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক একপর্যায়ে ওই সব সম্পত্তি নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে টাকা উদ্ধারের রায় পায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই সম্পত্তি বিক্রি করেও টাকা ওঠে না। আবার নতুন মামলা করতে হয়।