স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার বছর না পেরোতেই ফের পানিতে ডুবেছে ফেনী ও নোয়াখালীর বিভিন্ন জনপদ। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমায় পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে বন্যার ক্ষত। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরছেন বন্যাদুর্গতরা। বন্যার ক্ষত নিয়েই ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।
ফেনী জেলার কয়েকটি উপজেলাÑ পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে বন্যায়। এসব এলাকার পানি নামতে শুরু করলেও এখনো দুর্ভোগ কমেনি সাধারণ মানুষের।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, বাঁধ ভাঙনের ফলে গত ৮ জুলাই থেকে পানি ঢুকতে শুরু করে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞার বিভিন্ন অঞ্চলে। প্লাবিত হয়েছে ১১২টি গ্রামের লাখো মানুষ। আশ্রয় নিয়েছেন জেলার ৮৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে, যার মধ্যে ৫ হাজার মানুষ ইতোমধ্যে ঘরে ফিরলেও অনেকেই এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন।
ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ
কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, বন্যায় ২ হাজার ৩৫০টির বেশি মৎস্য ঘের ও পুকুর এবং ১ হাজার ৬৫৫ হেক্টর আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬৫ লাখ টাকা।
ফুলগাজীর বাসিন্দা আছমা আক্তার বলেন, ‘রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই, চাল-ডাল পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। বাজারেও প্রয়োজনীয় জিনিস মিলছে না।’
পরশুরামের হালিম চৌধুরী বলেন, ‘২ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে নতুন ঘর করেছি, কিন্তু এখনো এক দিনও থাকতে পারিনি, বাঁধ ভেঙে ঘর চোখের সামনে তলিয়ে গেল।’
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, বন্যা মোকাবিলায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ত্রাণ কার্যক্রমে সাড়ে ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, আরও ৪০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী উদ্ধার ও ত্রাণে সহযোগিতা করছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, পাঁচ দিন ভারী বৃষ্টির পর এখন বৃষ্টি বন্ধ রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পরশুরাম ও ফুলগাজীতে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও ছাগলনাইয়া ও সদর এলাকায় পানি কিছুটা বেশি। বাঁধ মেরামতের সিদ্ধান্ত পানি নামার পর নেওয়া হবে।
নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
টানা বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নোয়াখালী জেলার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ১ লাখ ৯২ হাজার ৫০৩ জন মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪৬টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৭ হাজার ২৬০ একর ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার খামার ভেসে গিয়ে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৭২০টি গবাদিপশু।
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খোলা হয়েছে ৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্র, যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন ১ হাজার ৮৫০ জন। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান জানান, ১ হাজার ৮১০টি প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে ৪৮৪ টন চাল ও ১২ লাখ টাকা নগদ সহায়তা।
ফেনী ও নোয়াখালীর মানুষ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে। তবে টেকসই বাঁধ, দুর্যোগ পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রম আরও জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে বারবার একই দুর্ভোগে না পড়তে হয় উপকূলীয় ও নদী তীরবর্তী এই জনপদের মানুষদের।
আপনার মতামত লিখুন :