ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানা মেরূকরণ শুরু হয়েছে দেশের রাজনীতিতে। জটিল হচ্ছে নির্বাচনি সমীকরণ। জনসর্মথন এবং দলের ইমেজ রক্ষা করতে মরিয়া সব রাজনৈতিক দল। দেশের সবচেয়ে বড় দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী উভয়ই মরিয়া জুলাই অভুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) কাছে টানতে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন তপশিল ঘাষণার আগ পর্যন্ত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে সংলাপের দরজা খোলা রয়েছে। যার মাধ্যমে জোট বদ্ধের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়। এদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতি এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রমাণে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের বিষয়ে সহঅবস্থানে রয়েছে জামায়াত ইসলামী ও এনসিপি। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, এনসিপি চাইলে জামায়াতের অবস্থান থেকে আলোচনা হবে। তবে, এনসিপির নেতারা বলছেন, জোটবদ্ধের বিষয়ে এখনই ভাবছেন না তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন দল হিসেবে এনসিপি তার রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়াতে কৌশলি অবস্থান নিচ্ছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনি জোট করা নিয়ে শুরু থেকেই ইতিবাচক বিএনপি। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে বলে জানিয়েছে দলটির শীষ নেতারা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য শরিক দলগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলছে বিএনপি। তবে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরে শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা ইতোমধ্যেই কৌশলে নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছেন। আসন চূড়ান্ত না হলেও নির্বাচনি এলাকায় যাতায়াত বাড়িয়েছেন এসব দলের নেতারা। স্থানীয়ভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি করছেন সুধী সমাবেশÑ অব্যাহত রেখেছেন প্রাথমিক গণসংযোগ কর্মসূচিও।
নির্বাচনি জোট নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনি জোটের বিষয়ে ইতিবাচক বিএনপি। একই সঙ্গে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে। বিএনপি এখন মূলত সেই দলগুলোর সঙ্গে জোট ও জাতীয় সরকার গঠনে মনোযোগী, যারা একযোগে আন্দোলনে এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। এর বাইরে কিছু ভাবা হচ্ছে না। সব গণতান্ত্রিক দলই নির্বাচনের আগে নানা কৌশল গ্রহণ করবে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী কৌশল অবলম্বন করে এবং কার সঙ্গে জোট করে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন ঘিরে যে দাবিদাওয়া তুলছে, তা তাদের বৃহত্তর কৌশলেরই অংশ। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আলোচিত পিআর পদ্ধতি প্রসঙ্গে বিএনপির এ নেতা বলেন, এই ব্যবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনের সুযোগ হারাবেন। কেউ যদি খুব জনপ্রিয়ও হন, কিন্তু কোনো দলে না থাকেন, তাহলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন না। এটি অন্যায় এবং অগণতান্ত্রিক। ছোট দলগুলো পিআর চায়, কারণ এতে তারা কম ভোট পেয়েও বেশি আসন পেতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে দুর্বল জোট সরকার গঠিত হবে এবং দেশে শক্তিশালী নেতৃত্ব গড়ে ওঠা কঠিন হবে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই বিএনপি মেনে নেবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, কয়েকটি দল বিভিন্ন দাবি করছে। কেউ সংস্কার চায়, কেউ বলছে বিচার ছাড়া নির্বাচন নয়, কেউ পিআর চায়। এসব বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে। তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী, সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন হবে। কথা বলার অধিকার সবাই রাখে, তবে সেসব বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও হতে পারে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্মান করি এবং তাদের জন্য শুভকামনা রাখি। কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক ওজন আসে জনসমর্থন থেকে। ছোট কিছু দল বড় কথা বললেও তারা অল্পসংখ্যক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। রাজনীতিতে জনমতের মূল্য সবচেয়ে বেশি।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, মোট ভোটের ভিত্তিতে সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব রাখার পক্ষে জামায়াত ইসলাম। নো ইলেকশন উইদাউট রিফর্মস। অন্তত নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত সেগুলোর সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে যে সময়টুকু প্রয়োজন সেটা দিতে হবে। তিনি বলেন, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সেই সময় দিতে জামায়াত প্রস্তুত।
জোটবদ্ধ নির্বাচনের বিষয়ে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার হাতকে শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নির্বাচনি জোট করতে পারে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন সেসব দলের জন্য আমাদের আলোচনার টেবিল উন্মুক্ত রয়েছে। যেহেতু এখনো অনেকটা সময় বাকি সুতরাং কাদের সঙ্গে জোট হবে সেটি সময় বলে দেবে।
নির্বাচনি জোটের বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশে জামায়াত এবং ইসলামী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠনের চেষ্টার পাশাপাশি নির্বাচনের পরিবেশের বিষয়ে সচেতন রয়েছে। একইসঙ্গে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি রয়েছে আমাদের। নির্বাচনি জোটের বিষয়ে প্রথমিক আলোচনা হয়েছে, চূড়ান্ত ফলের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। সেখানে এনসিপি জোটবদ্ধ হতে চাইলে জামায়াতের অবস্থান থেকে আলোচনা হতে পারে।
এ বিষয়ে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম তুহিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচনি জোট নিয়ে এখনই কিছু ভাবছি না আমরা। জোটের বিষয়ে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত থাকলেও তাতে পা না বাড়ানোর পক্ষেই নীতিনির্ধারকরা। মূল দাবিগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা এসবে গুরুত্ব দেব না। জুলাই ঘোষণাপত্র, সনদ, বিচার এবং মৌলিক সংস্কারÑ এসবের দৃশ্যমান অগ্রগতি হতে হবে। জুলাই সনদের পর তপশিল ঘোষণা হলে তখন আমরা এসব নিয়ে (নির্বাচন বা জোট গঠন) আলাপ-আলোচনা করব।
এদিকে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির নেতারা মনে করেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের দাবি মূলত একই। এর মধ্যে বিচার ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বিএনপি সংস্কারের ব্যাপারে সবচেয়ে আন্তরিক। তবে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যেই আলোচনা শেষ হওয়া উচিত ছিল। দলটি আশা করে, এ আলোচনা আর বেশি দিন চলবে না। দ্রুতই জুলাই সনদ করতে পারবে, যেখানে সব দলের স্বাক্ষর থাকবে। আর জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়েও বিএনপি ইতিবাচক। এ সংক্রান্ত নতুন খসড়া সংযোজন-বিয়োজন করে সরকারকে ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। এবং চূড়ান্তভাবে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে নির্বাচনি চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হবে।