ঢাকা শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫

নির্বাচন ঘিরে গভীর ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি

রুবেল রহমান
প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২৫, ১২:১২ এএম

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঠিক কবে তার নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলেও আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল তা মুছে দিতেই গোপালগঞ্জে এনসিপির ওপর আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলা এমনটাই মনে করছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নেতারা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে মনে করছে দলটি। বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের সন্দেহ, হামলা-সংঘর্ষের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে কটূক্তি এবং দলের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারও নির্বাচন ঠেকানোর নীলনকশার অংশ।

গত বুধবার গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষ এবং সম্প্রতি রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এক যুবকের নিহত হওয়াসহ এর আগে-পরের কিছু ঘটনায় বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের বিশ্লেষণে এই অভিমত উঠে এসেছে। নির্বাচন পেছাতে আগে থেকেই দুটি রাজনৈতিক দল ষড়যন্ত্র করছে এমনটাই মনে করছে বিএনপি। 

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির ওপর হামলাকে ন্যক্কারজনক দাবি করে, প্রশাসনকে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা। দেশের স্বার্থে ঐক্য ধরে রাখা না গেলে ষড়যন্ত্রকারীরা ঘোলাপানিতে ফায়দা লুটতে পারে, এমন শঙ্কা রাজনীতিবিদদের। জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ যেন বিনষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশ্লেষকদের। আওয়ামী লীগের রাজনীতির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে সহিংসতা ও ৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজনীতির মাঠে। এমন পরিস্থিতিতে কোন দিকে মোড় নিচ্ছে রাজনীতি? বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগের আচরণ বরাবরই এমন। জনগণের কাছে এমন শোচনীয় পরাজয়ও মানতে পারছে না। এরই মধ্যে এনসিপি নেতা হান্নান মাসুদ মুখ ফুটে বলেই ফেলেছেন, জাতীয় নেতাদের নির্বাপত্তা দিতে ব্যর্থ সরকার, তারা কী করে করবে নির্বাচন। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। যেভাবে বৈধ রাজনৈতিক দলের ওপর নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল হামলা চালিয়েছে, এটা শুধু নিন্দনীয় নয়, এটা ন্যক্কারজনক। কিছু রাজনৈতিক দল ধরেই নিয়েছে, নির্বাচন হলে তারা ভোট পাবে না, আর তাই নির্বাচন ঠেকাতে যত ধরনের অপচেষ্টা আছে তা করেই যাচ্ছে কেউ কেউ।  

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা আছে, একটি মহলের ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠনের পরিকল্পনা আছে। এরই অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা চলছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এর মাধ্যমে একটি পক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ যেমন নষ্ট করার চেষ্টা করছে, তেমনি বিভিন্ন ঘটনায় অপপ্রচার চালিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে। 

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালের সামনে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার নেপথ্যে পল্লী বিদ্যুতের চোরাই তার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। পরবর্তী সময়ে স্বার্থগত দ্বন্দ্বের জেরেই এই খুনের ঘটনা ঘটে। এর সঙ্গে চাঁদাবাজি কিংবা দলীয় কোনো বিষয় নেই।

গত বৃহস্পতিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে যেন নির্বাচন না হয়, সে জন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সুযোগ সৃষ্টি হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। গণতন্ত্রের যেন উত্তরণ না ঘটে সে জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বিএনপির মতো এত ত্যাগ কেউ স্বীকার করেছে কি না তা জানা নেই। ২০ হাজার নেতাকর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এত কিছুর পরও বিএনপি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। একবারের জন্যও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই থামায়নি।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচন নিয়ে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হলো, তা অনেকের সহ্য হচ্ছে না। এর পর থেকেই ষড়যন্ত্র, শুরু হলো সংঘাত, রক্তপাত চলছেই। সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে বলেও মনে করেন রিজভী।  

বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করেন, কয়েকটি রাজনৈতিক দল দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে, এটা পরিষ্কার। বর্তমান সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা গেলে দেশে তাদের এক ধরনের কর্তৃত্ব থাকবে। নির্বাচন হলে তারা হয়তো ক্ষমতায় যেতে পারবে নাÑ এমনটি ভেবে বিএনপিকে ঠেকানোর অংশ হিসেবে নানা ঘটনার পরিকল্পনা করছে তারা। এ কাজে নতুন একটি দলকে তারা ব্যবহার করছে। এসব বিষয়ে গত বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। সেখানে নেতারা বলেন, বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে ইস্যু সৃষ্টি করে বিএনপিকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচন ঠেকানো। কারণ নির্বাচন ছাড়াই যারা ক্ষমতার স্বাদ পাচ্ছে, নির্বাচনের পর তাদের সেই ক্ষমতা নাও থাকতে পারে।

গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের পরদিন এক বিবৃতিতে দলটি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে একটি মহল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। দলটি মনে করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিভিন্ন কায়দায় ইস্যু সৃষ্টি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি মহল দেখাতে চায়, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। সব কিছুর পেছনে ওই একটি কারণ। তা হলো নির্বাচনকে বিলম্বিত করা। এসব করে খুব একটা লাভ হবে না, দেশের মানুষ ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিচক্ষণ আচরণ করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। গোপালগঞ্জের হামলায় আসলে কে লাভবান হলো? না সেই অর্থে কেউ লাভবান হয়নি। আওয়ামী লীগের এইটুকু লাভ হয়েছেÑ গোপালগঞ্জে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটা তারা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা এই বিশ্লেষকের।