আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। এদিকে, রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার, গণসংগতি, নাগরিক ঐক্যসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল। যার মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যে দোদুল্যমানতা ছিল তা কেটে গেছে। তবে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের আগে জুলাই গণহত্যাকারীদের বিচার, রাষ্ট্র কাঠামোর গুণগত পরিবর্তন, বিচারকাজ দৃশ্যমান, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতসহ আরও কিছু দাবি জানানো হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে।
এর আগে গত মঙ্গলবার জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রমজানের আগে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাব, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন’। এ ছাড়াও গত জুন মাসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠকের পর এক ‘যৌথ ঘোষণায়’ বলা হয়, সব প্রস্তুতি শেষ হলে ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই নির্বাচন হবে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের যে ঘোষণা তাকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বুধবার বলেছেন, বিএনপি মনে করে এই ঐতিহাসিক ঘোষণা বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে এবং গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সুগম করবে। তিনি বলেন, বিএনপি আশা করে, এই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সরকার, নির্বাচন কমিশন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একটি কার্যকরী জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য বিএনপি সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে। এ নির্বাচনকে ‘অতি জরুরি’ হিসেবে বর্ণনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এখন এই নির্বাচনটা দেশের জনগণই চায়। জনগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সবচেয়ে বড় প্রহরী হয়ে দাঁড়াবে। নির্বাচন ইস্যুতে মির্জা ফখরুল আরও বলেন, খুব শিগগিরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হবে এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়ন হবে। শত নির্যাতনের পরও বিএনপির নেতাকর্মীরা দমে যায়নি, কখনো মাথা নত করেনি। আমরা একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই।
নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে জুলাই ঘোষণাপত্র জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি, আরও অনেক বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। এখানে আরও অনেক বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত ছিল। আমরা আশা করি যে, বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নির্বাচনের সময় ঘোষণার বিষয়ে ইতিবাচক উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার দীর্ঘদিনের যে ঐতিহ্য, তা উপেক্ষা করে জুলাই ঘোষণার দিনেই নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে। তথাপি জাতীয় স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল।
অতীতে সব গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ ও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল। সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনি প্রস্তুতি চলছে। আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল, তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকার যে সময়সীমার মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে চায়, তাতে আপত্তি নেই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। তবে নির্বাচন আয়োজনের আগে গণহত্যাকারীদের বিচার, রাষ্ট্র কাঠামোর গুণগত পরিবর্তন, নির্বাচনের আগে বিচারকাজ দৃশ্যমান, নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতাসহ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। আখতার হোসেন বলেন, গত বছর জাতীয় শহীদ মিনারে একত্র হয়ে জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছিল। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত মঙ্গলবার জুলাই ঘোষণাপত্র পেয়েছি, তাতে জুলাইয়ের সব শহীদকে জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জুলাইয়ের সব আন্দোলনকারী, শহীদ পরিবার, আহত সবাইকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কথা, প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান বলেছেন, সব দিক বিবেচনায় রমজানের আগে নির্বাচন করা খুবই ভালো পদক্ষেপ, আমরা এটিকে স্বাগত জানাই। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে কীভাবে তারা এই নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। রমজানের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবি পার্টি। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি দৃশ্যমান বিচার ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে দলটির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। নির্বাচনের সময় ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে গণসংহতি আন্দোলনও। দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এক বিবৃতিতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য জাতীয় নির্বাচন অত্যাবশ্যক, এর সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা জনজীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আমরা মনে করি।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সময় ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ। দলটির সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করাকে স্বাগত জানাচ্ছে গণঅধিকার পরিষদ, এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির আগে নির্বাচন চাই, তবে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নির্বাচনে আপত্তি নেই। তবে বর্তমান প্রশাসন নিরপেক্ষ না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন এটাকে স্বাগত জানাই। এখন প্রধান উপদেষ্টার চিঠি গেলে ইসি আশ্বস্ত হবে। তারা বিস্তারিত সূচি সেটা দেবে। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে এতদিন যে রাজনৈতিক দলগুলোতে দ্বিধা, অবিশ্বাস, সন্দেহ ছিল তা কেটেছে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নির্বাচনের ব্যাপারে একধাপ অগ্রগতি। তবে আমরা মনে করি, এখনো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, আমরা মানসিকভাবে ধরে নিয়েছিলাম, আগেও বলেছিলেন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করবেন। সে হিসেবে ঠিকই আছে।
ভাসানী জনশক্তি পার্টি ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘোষণা করায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। দলটি মনে করে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য হবে এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করবে। এ ছাড়াও নির্বাচনের সময় ঘোষণা করায় স্বাগত জানিয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দল।
প্রসঙ্গত, গত জুন মাসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠকের পর এক ‘যৌথ ঘোষণায়’ বলা হয়, সব প্রস্তুতি শেষ হলে ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই নির্বাচন হতে পারে। তাতে সন্তুষ্ট হলেও বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ও তপশিলের দাবি জানিয়ে আসছিল।