সব জল্পনা-কল্পনা এবং নাটকীয়তার পর জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মধ্যমে নির্বাচনি ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়েছে। তবে আইনি বৈধতাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রথমে এনসিপি, জামায়াতসহ কয়েকটি দল সনদে স্বাক্ষরের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তবে শেষ মুহূর্তে সব ধোঁয়াশা কাটিয়ে সনদে স্বাক্ষর করে বিএনপি, জামায়াত, গণফোরামসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল। প্রথমে বিরুদ্ধে থাকলেও পরবর্তীতে জামায়াতের জুলাই সনদে স্বাক্ষরকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ হয় এনসিপি। সনদে স্বাক্ষর ইস্যুতে এখন জামায়াত-এনসিপি দুই দলের পথ ভিন্ন হয়ে গেল। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিভিন্ন দাবি ও আন্দোলনে সহ-অবস্থানে থাকা দল দুইটির মধ্যে গড়ে ওঠা মধুর সম্পর্কে তিক্ততার জোয়ার শুরু হলো বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন দাবিতে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একই পথে হেঁটেছে। নানা ইস্যুতেই সহাবস্থান ছিল দল দুটির। কিন্তু জুলাই জাতীয় সনদ যেন দুই দলকে দুটি পথে বিভক্ত করে দিল। জামায়াত সনদে স্বাক্ষর করল। স্বাক্ষর করল না এনসিপি।
এদিকে, জামায়াত ও এনসিপি উভয়েই জানিয়েছিল, তারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া এতে স্বাক্ষর করবে না। সনদ স্বাক্ষরের আগের দিন গত বৃহস্পতিবার এনসিপি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে। সেদিন বিকেলে জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবে। তবে সনদে স্বাক্ষর করবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। পরদিন জামায়াতের নেতারা অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং সনদে স্বাক্ষর করেন। জামায়াতের এমন পদক্ষেপকে এনসিপির পক্ষ থেকে ‘বেঈমানি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
দল দুটির বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. রইস উদ্দিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে রাজনীতির নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হয়েছে। দেশ এবং জাতির কল্যাণে সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত থাকা উচিত। তবে বিগত সময়ে দল দুটির (জামায়াত-এনসিপি) মধ্যে যে সু-সম্পর্ক দেখা গেছে তার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছে, দল দুটির নেতাদের কথায় তা স্পষ্ট। তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় তাদের পছন্দের প্রতিনিধি ভোটের মাধ্যমে বাছাই করতে পারেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের জনগণ এখন নির্বাচন চায়। ফেব্রুয়ারিতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দলকে দেশের স্বার্থে এক থাকা উচিত। বিএনপি, জামায়াত বা এনসিপি নয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে এক থাকতে হবে। অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি এক থাকা জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
যা হচ্ছে, সবই রাজনৈতিক খেলা মন্তব্য করে এই বিশ্লষক বলেন, কোনো দলের পরিপক্বতা বা গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে জনগণের সর্মথন বা ভোটের ওপর। কোনো দলের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি কাম্য নয়। যুক্তির খ-ন হবে যুক্তি দিয়ে, এমনটাই কামনা করি।
জুলাই সনদে স্বাক্ষর নিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্যের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে কাগজে সই করছে। যারা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে, গণঅভ্যুত্থান থেকে এবং জনগণ থেকে তারা ছিটকে পড়েছে।
জামায়াতকে উদ্দেশ করে নাহিদ বলেছেন, তথাকথিত ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) আন্দোলন’, যা জামায়াতে ইসলামী চালু করেছিল, তা ছিল একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা। এটি ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং জনগণের উত্থানের আলোকে রাষ্ট্র ও সংবিধানের পুনর্গঠনের মূল প্রশ্ন থেকে জাতীয় সংলাপকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল।
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার মূল সংস্কারের দাবি ছিল একটি সাংবিধানিক সুরক্ষা হিসেবে কল্পনা করা। আমরা এ ধরনের মৌলিক সংস্কারের চারপাশে একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং বিস্তৃত জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জামায়াত এবং তাদের মিত্ররা এই এজেন্ডাকে হাইজ্যাক করেছে, এটিকে একটি কারিগরি পিআর ইস্যুতে পরিণত করেছে এবং তাদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের জন্য দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের উদ্দেশ্য কখনোই সংস্কার ছিল না; এটি ছিল কারচুপি।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন সম্পর্ক থাকে, এনসিপি আর জামায়াতের মধ্যেও তেমন রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। জামায়াত আর এনসিপির মধ্যকার সম্পর্ক সব সময় মিডিয়া ফ্রেমিং করেছে। আমাদের মধ্যে আলাদা কোনো দূরত্বের বিষয় নেই।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেছেন, জামায়াত আসলে কোনো ধরনের গণমানুষের দল নয়। জামায়াত এবং আওয়ামী লীগকে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হিসেবে আমরা দেখে এসেছি।
সমসাময়িক ইস্যুতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, এনসিপির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগের মতোই আছে। আমাদের মধ্যে জোটের সম্ভাবনা আছে কি না তা নিশ্চিতভাবে বলতে সময় প্রয়োজন।’ জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী দলগুলো জুলাই চেতনা থেকে ছিটকে গেছে বলে এনসিপির প্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটাকে তাদের ‘পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরেক সহকারী সেক্রেটারি আব্দুল হালিম বলেন, ‘এনসিপি জুলাই অভ্যুত্থানে নায়কের ভূমিকা রেখেছিল, কাজেই তাদের একটু কথা থাকবেই। তাদের স্বাক্ষরে রাজি করাতে পারলে সেটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর হতো। সবার জন্যই ভালো হতো।’ এনসিপির বিষয়গুলো সরকারকে বিবেচনা করা উচিত বলে জানান তিনি। তবে এসবের ফলে দুই দলের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না, মন্তব্য করেন আব্দুল হালিম।
প্রসঙ্গত, ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট জুলাই সনদে সই করেছে। যারা বাকি আছেন, তাদের জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার আহ্বান জানান জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদের নেতারা যাননি এবং স্বাক্ষরও করেননি।