নানা জল্পনা-কল্পনার পর গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সেনা হেফাজতে থাকা সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন ১৫ কর্মকর্তাকে হাজিরের পর কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সাথে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্য পলাতকদের আদালতে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের আদেশের পর সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সেনানিবাসের বাশার রোডে সাব-জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
গতকাল বুধবার শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কারা কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে আসামিরা কোন কারাগারে থাকবেন। তিনি বলেন, ‘তাদের কাস্টডিতে (কারাগারে) প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার মানে কারা কর্তৃপক্ষের অধীনে চলে যাবেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাদের কোথায় রাখবেন অর্থাৎ কোন জেলে রাখবেন কোন সাব-জেলে রাখবেন, ঢাকায় রাখবেন না চট্টগ্রামে পাঠাবেন বা অন্য কোথাও রাখবেন এই অথরিটি কারা কর্তৃপক্ষের অর্থাৎ সরকারের’। তাদের নতুন বাসে আনা হয়েছেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কারা কর্তৃপক্ষ তাদের কী পদ্ধতিতে আদালতে হাজির করবেন, এটা কারা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই বলার নাই’। তবে সেনা কর্মকর্তাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. সরওয়ার হোসেন বলেন, ‘ওই সেনা কর্মকর্তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছে। তারা নির্দোষ এবং সেটি আদালতে প্রমাণ হবে। যারা অপরাধ করেছে তারা ভারতে পালিয়ে গেছে।’
কড়া নিরাপত্তায় আদালতে হাজির
সেনা কর্মকর্তাদের হাজির উপলক্ষে পুরাতন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আশপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা দেখা যায় গতকাল ভোর থেকেই। অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএনের বিপুলসংখ্যক সদস্যদের উপস্থিতি ছিল অন্যদিনের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এরপর সবুজ একটি প্রিজন বাস ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করে সকাল ঠিক সোয়া ৭টার দিকে। এরপর একে একে গাড়ি থেকে নামানো হয় সেনা কর্মকর্তাদের। তাদের সবাই ছিলেন সাধারণ পোশাকে। কারো কারো মুখে ছিল মাস্ক।
এদিন শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল না, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, পল্টন, কাকরাইল মোড়সহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনী, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান ও টহল দেখা গেছে। ভোর থেকে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় সবাইকে বিশেষ চেকিং পার হয়ে ঢুকতে হয়েছে। বিশেষ প্রিজন বাস বানানো হয়েছে। সবুজ সেই বাসে লেখা ছিল, বাংলাদেশ জেল, প্রিজন ভ্যান।
এর আগে মঙ্গলবার অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জিএমএই তামীম জানিয়েছিলেন, সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির করার পর ট্রাইব্যুনাল যদি তাদের জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন, তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কারা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে তারা কোন কারাগারে থাকবেন। গতকাল আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের আইনজীবীরা জামিন আবেদনের পাশাপাশি সাব-জেলে রাখারও আবেদন করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তারা গুমের সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আসামি ১৭ জন, আরেক মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৩ জনকে। গত কয়েকদিন থেকেই নানা ধরনের গুঞ্জন ছিল যে, সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে আনা হবে কি না। গতকাল সকাল থেকে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা নিয়ে ব্যাপক নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। আরেকটি আবেদনÑ এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার বাইরে যারা পলাতক রয়েছে বিশেষ করে শেখ হাসিনা ও র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ, তারেক আহমেদসহ অন্য যারা পলাতক রয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম কোনো গুমের মামলায় আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে।
মামলার আসামি কারা?
গুম-নির্যাতনের ঘটনায় করা দুটি মামলার একটিতে আসামি ১৭ জন। তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (এখন অবসরকালীন ছুটিতে); র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম এখন সেনা হেফাজতে আছেন।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুম-নির্যাতনের আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনা, তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিজিএফআইয়ের সাবেক তিনজন পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী এখন সেনা হেফাজতে আছেন।
এই মামলার আসামিদের মধ্যে আরও আছেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচজন মহাপরিচালক। তারা হলেনÑ লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক।
গতকাল আদালতে আনা ওই সেনা কর্মকর্তারা বিগত সরকারের আমলে দুটি গুমের মামলার আসামি। তাদের মধ্যে কয়েকজন গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় হত্যা মামলারও আসামি। সেনা কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির করা উপলক্ষে ঢাকার কাকরাইল, মৎস্য ভবন, পল্টনসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়। কারাগারে সবুজ একটি বিশেষ বাসে করে হাজির করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের। ট্রাইব্যুনালে হাজিরের পরই তাদের নামানো হয় গাড়ি থেকে। ওই সেনা কর্মকর্তাদের সবাই ছিলেন সাধারণ পোশাকে। গত ৮ অক্টোবর অভিযোগপত্র গ্রহণের পর ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেন এবং পরোয়ানা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন পুলিশ মহাপরিদর্শককে। এর দুই দিন পর গত ১১ অক্টোবর সেনাবাহিনী একটি ব্রিফিং করে জানায়, সেনাবাহিনীতে কর্মরত ১৫ জন কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনাসহ ১৭ আসামিকে হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ
মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ও বর্তমান সেনা সদস্যসহ ১৭ জন পলাতক আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল সকালে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
তিন মামলার মধ্যে দুটি মামলার অভিযোগ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত অপরাধের ঘটনা। এই তিন মামলায় সাবেক ও বর্তমান ২৫ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৩২ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ জনকে বুধবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় এবং আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বাকি ১৭ জন পলাতক রয়েছেন।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম পলাতক আসামিদের হাজির করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আবেদন জানান। আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করে আগামী সাত দিনের মধ্যে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন।
যাদের নামে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, র্যাবের সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ মহাপরিচালক, র্যাবের সাবেক তিন মহাপরিচালক, বেনজীর আহমেদ, এম খুরশিদ হোসেন ও মো. হারুন-অর-রশিদ, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম ও মো. মশিউর রহমান।
সাব-জেল কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে, খাবার-সাক্ষাৎ বিধি অনুযায়ী : আইজি প্রিজন
আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের তিন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ সেনা কর্মকর্তা যে সাব-জেলে (অস্থায়ী কারাগার) আছেন সেটি কারা কর্তৃপক্ষেরই তত্ত্বাবধানে থাকবে। কারাবিধি অনুযায়ী তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব কারা অধিদপ্তরের এবং তাদের খাওয়া-দাওয়াও এই নিয়মে কারাগার থেকে দেওয়া হবে। গতকাল বুধবার কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন এ তথ্য জানান।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরিপ্রেক্ষিতে এদিন আদালতে হাজির হলে ওই কর্মকর্তাদের কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল। আদালতের আদেশের পর তাদের ঢাকা সেনানিবাসের বাশার রোডে সাব-জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আইজি প্রিজন জানান, ওই বন্দিদের নিরাপত্তায় কারাগার থেকে কারারক্ষী ও কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন। কারা বিধি অনুযায়ী বন্দিদের দেখাশোনার দায়িত্ব কারা অধিদপ্তর থেকেই এবং তাদের খাওয়া-দাওয়াও একই নিয়মে কারাগার থেকেই দেওয়া হবে। তাদের কোনো স্বজন দেখা করতে চাইলেও অনুমতি সাপেক্ষে কারাবিধি অনুযায়ী দেখা করার ব্যবস্থা করা হবে। বাইরে থেকেও কোনো খাবার দেওয়া হলেও এই বিধি অনুযায়ী পরীক্ষার মাধ্যমে সেগুলো দেওয়া হবে।
পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের আমলে গুম-খুন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকা-সহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক তিন মামলায় অভিযুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে বুধবার সকালে ঢাকা সেনানিবাসের ‘সাব-জেল’ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। পরে আদালত ওই কর্মকর্তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ ছাড়া মামলায় শেখ হাসিনাসহ অন্য পলাতক আসামিদের বিষয়ে সাত দিনের মধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলা হয়েছে।
এ তিন মামলায় ২৫ জন সাবেক-বর্তমান সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৩২ জন আসামি। তাদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার তথ্য জানা যায়।
গত ১১ অক্টোবর ঢাকা সেনানিবাসের মেসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছে তাদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে সেনা হেফাজতে আছেন। চার্জশিটে প্রায় ২৫ সেনা কর্মকর্তার নাম এসেছে। এর মধ্যে অবসরে আছেন ৯ জন, এলপিআরে একজন এবং কর্মরত আছেন ১৫ জন। যারা অবসরে গেছেন, তাদের ক্ষেত্রে আমাদের সেনা আইন প্রযোজ্য নয়।