ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫

বিএনপি না জামায়াত

জোট নিয়ে দোলাচালে এনসিপি

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৫, ১১:১৩ পিএম

অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সর্বশেষ ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরের মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পথ সুগম হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সে অবস্থান স্পষ্ট করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা না হলেও রাজনীতিতে ভোট ঘিরে দলগুলোর জোটকেন্দ্রিক আলোচনা দেশজুড়ে। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন ঘিরে বিএনপি না জামায়াতের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতায় যাচ্ছেÑ সেটাই এখন মূল আলোচ্য বিষয়। এনসিপি সূত্রে জানা যায়, দলের মধ্যেও চলছে নির্বাচনি জোট এবং আসন সমঝোতার হিসাব।

এদিকে বিএনপি এবং জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও হয়েছে কয়েকবার। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নাকি জামায়াতÑ কোন দলের সাথে যাবে এনসিপি, সেই আলোচনা এখন দলের মধ্যে সরব। এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিএনপি ও জামায়াত দুই জোটের সাথে নির্বাচনি জোট বা সমঝোতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলানো হচ্ছে। একই সাথে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে আদর্শগত দিকগুলোও।

এনসিপির একটি পক্ষের মত, জামায়াতের সাথে সরাসরি জোট না করে নির্বাচনি সমঝোতায় যাওয়া দলের জন্য ভালো। অপর আরেকটি পক্ষ মনে করে, বিএনপির সাথেই নির্বাচনি আসন ভাগাভাগি বা জোটে যাওয়া যৌক্তিক। এ নিয়ে দুটি দলের সাথেই অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও চলছে বলে জানা যায়। তবে দলটির বেশকিছু শীর্ষ নেতা মনে করছেন, বিএনপি বা জামায়াত কোনো দলের সঙ্গেই জোটে না গিয়ে একক কিংবা এনসিপির নেতৃত্বে আলাদা জোট করে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া দলটির জনপ্রিয়তা রয়েছে। একই সাথে রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যদি তাদের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে চায় তাহলে দলটির উচিত এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সেটা তাদের জন্য মাইলফলক হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. স ম আলী রেজা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তরুণদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের উদ্দেশ্যে এনসিপি গঠিত হয়েছে। সেই স্থান থেকে একটি শক্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়াতে চাইলে তাদের কৌশল হওয়া উচিত এককভাবে নির্বাচন করা। তবে চাইলে তারা দুয়েক জায়গায় আসন সমঝোতাও করতে পারে।

এনসিপির একটি সূত্র দাবি করছে, যদি শেষ পর্যন্ত পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য তৈরি হয় তাহলে কোনো জোট ছাড়াই এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে দলটির। এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, এনসিপি কারো সাথে জোটে যাচ্ছে কি না অথবা এককভাবে নির্বাচন করবে কি নাÑ সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো হয়নি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করছে তার দল। সময় হলেই দলের পক্ষ থেকে সেটি জানানো হবে।

এদিকে ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এনসিপি গঠনের নানা ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর এক ধরনের সখ্য দেখা যায়। যার বিপরীতে বিএনপির সাথে এক ধরনের বৈরী সম্পর্কও দেখা যায়। তবে জুলাই সনদ স্বাক্ষর ঘিরে জামায়াতের সাথে এক ধরনের টানাপোড়েনও তৈরি হয় এনসিপির। যা স্পষ্ট হয় এনসিপির শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলামসহ দলের শীর্ষ নেতাদের বাক্য বিনিময়ে।

সে স্থান থেকে বিএনপির সাথে জোটে যাচ্ছে কি এনসিপি? চলছে এমন আলোচনাও। রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই সনদ কিংবা রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে গত কয়েক মাস ধরেই বিএনপির সাথে এনসিপির এক ধরনের টানাপোড়েন দেখা যায় রাজনীতির মাঠে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে এনসিপি নেতাদেরও অনেককে বিএনপির সমালোচনাও করতে দেখা গেছে। একই সাথে বিএনপি নেতাদেরও অনেককে এনসিপির সমালোচনা করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি ও এনসিপির মতপার্থক্য দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বাড়তে থাকে। সর্বশেষ, সংস্কারের বেশকিছু ইস্যুতে বেশ মতপার্থক্য দেখা গেছে বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে।

তবে দুটি দলের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেও বিএনপির সাথে নির্বাচনি সমঝোতা কিংবা জোট গঠনের আলোচনার জন্য কথাও বলেছে দলটির কয়েকজন নেতা। তবে এনসিপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির সাথে জোট গঠনের বিষয়ে এনসিপির মধ্যে দুই ধরনের অবস্থান আছে নেতাদের মধ্যে।

দলের যে পক্ষটি বিএনপির সাথে জোট গঠনের পক্ষে। তারা বলছেন, নির্বাচনে যদি বেশিসংখ্যক আসন ছাড় দেওয়া হয় তাহলে বিএনপির জোটে যেতে আগ্রহী তারা। সেক্ষেত্রে এনসিপির প্রত্যাশা অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি আসনে যদি বিএনপি ছাড় দেয়, তাহলে তারা বিএনপির জোটে কিংবা বিএনপির সাথে আসন সমঝোতায় যেতে রাজি। আর অন্য পক্ষটির বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচনে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কোনো আসনে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করতে পারে। যেটি এনসিপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

তবে এ বিষয়ে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, বিএনপির সাথে জোট বা আসন সমঝোতাÑ কোনো বিষয়েই সিদ্ধান্ত এখনো দল নীতিগতভাবে নেয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত এনসিপির সাথে জোট বা সমঝোতার সুযোগ আছে বলছেন বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। এ নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে দুই দলের নেতাদের মধ্যে যোগাযোগও হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নাই। নির্বাচনের আগে মাঠের পরিস্থিতি দেখেই তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কোন দল কোন দলের সঙ্গে জোটে যাবে সেটির জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

এখন জামায়াত নিয়েও দলের মধ্যে আলোচনা চলছে। গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে জামায়াতসহ ছয়টি দল পাঁচটি অভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নামে। সেখানে এনসিপির থাকার কথা ছিল। তবে সেখান থেকে সরে যায় এনসিপি। একই সাথে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জামায়াতের যোগ দেওয়া এবং স্বাক্ষর নিয়ে টানাপোড়েন তৈরি হয়। সর্বশেষ পিআর বা আনুপাতিক নির্বাচনের দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনকে সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা বলে মন্তব্য করে এনসিপি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে জামায়াতের সাথে নির্বাচনি সমঝোতা কিংবা জোট গঠনের সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়েও নানা আলোচনা চলছে।

এনসিপির একটি পক্ষের অবস্থান, নির্বাচনের মাঠে জামায়াতের সাথে জোট বা আসন সমঝোতা হলে সেক্ষেত্রে বেশি আসন ছাড় দিতে পারে জামায়াত। অন্যদিকে জামায়াতের ক্ষেত্রে বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটে অংশ নেবে না বলেও মনে করে একটি পক্ষ। যে কারণে দলটির কোনো কোনো নেতা বিএনপির চাইতে জামায়াতের সাথে জোট গঠনের বিষয়ে আগ্রহী। আর অন্যপক্ষটির মতামত হচ্ছেÑ শেষ পর্যন্ত যদি জামায়াতের সাথে সমঝোতা বা জোট করে নির্বাচনে অংশ নেয় এনসিপি, তাহলে বিরোধী দলে অবস্থান হতে পারে দলটির। অন্যদিকে, জামায়াতের রাজনীতির ট্যাগও দলটিকে পিছিয়ে দিতে পারে। সেইদিক বিবেচনা করে ওই পক্ষটি জামায়াতের সাথে জোট বা আসন সমঝোতার বিষয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টাদের একজন জামায়াতের সাথে জোট বা সমঝোতায় না যাওয়ার পক্ষেও তার অবস্থানের কথা এনসিপিকে জানিয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, জোটের বিষয়ে এখনো সময় রয়েছে। আরেকটু সময় গেলে স্পষ্ট হবে কে কোন জোটে বা কার সাথে সমঝোতায় যাবে। এনসিপির সাথে সমঝোতা বা জোট গঠনের সুযোগ তো আছেই। আমরা আলোচনা করছি, আমাদের মধ্যে মতবিনিময়ও হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে।