বাংলাদেশের স্বাস্থ্য প্রশাসনে বড় ধরনের পুনর্গঠন আসছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ‘স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ’ এবং ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ’Ñ এ দুটি পৃথক বিভাগকে একীভূত করে পুনরায় একটি একক মন্ত্রণালয়ে রূপ দিয়েছে সরকার।
সরকার স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের দায়িত্বে একই সচিবকে নিযুক্ত করেছে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমানকেই এখন থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করতে হবে। এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
এর আগে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা সচিব সাইদুর রহমান জানিয়েছিলেন যে, স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ একীভূত হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত সচিব কমিটির পর্যালোচনা ও অনুমোদনের পর বিষয়টি জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এ-সংক্রান্ত অনুমোদনও দেওয়া হয়েছিল।
দুই বিভাগে বিভাজনের পটভূমি :
২০১৭ সালের ১৬ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দুটি পৃথক বিভাগে বিভক্ত করা হয়Ñ ‘স্বাস্থ সেবা বিভাগ’ এবং ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ’। এর মাধ্যমে প্রশাসনিক কাঠামোয় নতুন পদ সৃষ্টি হয়। সচিব কমিটির অনুমোদন অনুযায়ী, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে ৩২৪টি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ২১১টি পদ অনুমোদিত হয়। ফলে মোট ৫৩৫টি প্রশাসনিক পদে কাঠামো গঠিত হয়।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রকে আরও দ্রুত, সহজ ও বিকেন্দ্রীকৃত করা। এ জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগকে আর চিকিৎসা শিক্ষা, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগকে।
প্রত্যাশিত সুফল না পাওয়া :
প্রায় আট বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এই দ্বিমুখী কাঠামো প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে পারেনি। বরং এতে সমন্বয়ের অভাব, দায়িত্ব বিভাজনের জটিলতা এবং প্রশাসনিক বিলম্ব বেড়েছে। দুই বিভাগের কার্যক্রমে পারস্পরিক সমন্বয়ের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মানে দৃশ্যমান অবনতি ঘটেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগ উভয়ের মতামতেও উঠে এসেছেÑ দুই বিভাগে বিভাজনের ফলে প্রশাসনিক সমন্বয় দুর্বল হয়েছে এবং সেবাপ্রদানের ধারাবাহিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে একই প্রকল্পে দুই বিভাগের মধ্যে দ্বৈততা তৈরি হয়েছে, যা কখনো কখনো নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
একীভূতকরণের প্রস্তাব :
এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬-এর বিধি ৩(৪) উপবিধি (১) ও বিধি ১০(১) অনুযায়ী স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগকে পুনরায় একীভূত করার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়। প্রধান উপদেষ্টা ইতিমধ্যে প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২ আগস্ট জারি করা ১০৭ নম্বর পরিপত্র অনুযায়ী প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত সচিব কমিটির সুপারিশ গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে ২০২৫ সালের ৭ মে জারি করা ৮০ নম্বর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নতুন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ পুনর্গঠনের প্রস্তাব নিকার কর্তৃক অনুমোদনের জন্য পাঠানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের ২৭ আগস্টের ১৫৬ নম্বর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী প্রাক-নিকার সচিব কমিটিতে বিষয়টি উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
প্রশাসনিক কাঠামো ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা :
প্রস্তাবিত পুনর্গঠনের ফলে দুটি পৃথক সচিবালয়ের পরিবর্তে একটি একীভূত প্রশাসনিক কাঠামো গঠিত হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সব পরিচালক, মহাপরিচালক, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তার সমন্বয়ে নতুন কাঠামো তৈরি হবে। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হবে দ্রুততর, বাজেট বরাদ্দে স্বচ্ছতা বাড়বে এবং নীতিগত দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নে সমন্বয় জোরদার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দুই বিভাগে বিভাজনের ফলে কখনো কখনো একই প্রকল্পে দুটি ভিন্ন বিভাগ আলাদা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে সময় ও সম্পদ দুটোই নষ্ট হয়েছে। একীভূত কাঠামো হলে এসব সমস্যা দূর হবে।
অতীত অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক মতামত :
স্বাস্থ্য খাতের দীর্ঘদিনের কর্মীরা বলছেন, ২০১৭ সালের বিভাজনের পর চিকিৎসা শিক্ষা, নার্সিং শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি ক্রমশ বেড়েছে। এমনকি একই কর্মসূচির বাজেট ও প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া দুই বিভাগে আলাদা পথে গিয়েছে, যার ফলে প্রশাসনিক দ্বন্দ্ব এবং নীতি বাস্তবায়নে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের যৌথ মতামতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বাস্থ্য খাতের নীতিগত সিদ্ধান্তে ঐক্য ফিরিয়ে আনার জন্য একীভূত কাঠামোই টেকসই সমাধান।
নিকার অনুমোদনের অপেক্ষায় :
এখন বিষয়টি প্রাক-নিকার সচিব কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশের পরই তা প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসসংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় উপস্থাপন করা হবে। অনুমোদন পেলে পুনর্গঠিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পুনরায় একীভূত প্রশাসনিক কাঠামোয় কার্যক্রম শুরু করবে।
নিকার অনুমোদনের পর নতুন কাঠামো কার্যকর হলে দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসনে নতুন অধ্যায় সূচিত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, একীভূত মন্ত্রণালয়ই কার্যকর নীতি, দ্রুত সিদ্ধান্ত ও জনমুখী সেবার নিশ্চয়তা দিতে পারবে।