জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনৈক্যের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছুতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারের দেওয়া সাত দিনের সময়সীমা শেষ হচ্ছে আজ সোমবার। যদিও এটা চূড়ান্ত সময়সীমা নয়। তবে সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই স্পষ্ট হয়েছে- দলগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সমঝোতা তৈরি হয়নি। বরং মতপার্থক্য আরও তীব্র হয়েছে। ফলে সংকট অচলাবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কি না, সে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর কৌতূহল ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
এ ছাড়াও প্রকাশ্যে চলছে দলগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর হুমকি। কিন্তু পর্দার অন্তরালে চলছে সমঝোতার চেষ্টা। এই সমঝোতা তৈরিতে সরকার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কারণ সরকার জাতীয় নির্বাচন দিয়ে নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করতে চাচ্ছে।
এ বিষয়ে সরকার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছে, সরকার সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যদি সমঝোতা নাও হয় তবু সরকার নিজেদের নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করবে। আর বিবদমান সব দল নিজ নিজ স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নিবে। তখন সংস্কার বিষয়টি গৌণ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে রাজনৈতিক একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পর্দার অন্তরালে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছে। লক্ষ্য, কোনোভাবে একটি যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। একটি সম্ভাবনার কথা রাজনৈতিক মহলে ঘুরছে, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিন (বিএনপির দাবি) আর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি সংসদে যুক্ত (জামায়াতের প্রস্তাব)। এমন একটি সমঝোতা হলে উভয় পক্ষই আংশিক সন্তুষ্ট হতে পারেÑ এমন মতও পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রকাশ্যে সরকার বা কমিশন কেউই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
বিশ্লেষকদের মতে সামনে তিনটি সম্ভাবনা রয়েছে, প্রথমত সরকার নিজস্ব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। গণভোট এবং নির্বাচনের সময়সূচি একতরফাভাবে ঠিক হতে পারে। এতে বিরোধী দলগুলোর প্রতিক্রিয়া তীব্র হতে পারে। দ্বিতীয়ত, পর্দার আড়ালে সমঝোতা সফল হবে। দুই দলের চাপ হ্রাস পাবে এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ কিছুটা পরিষ্কার হবে। এবং তৃতীয়ত রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হবে। জামায়াতের ১১ নভেম্বর সমাবেশ ও বিএনপির ৭ নভেম্বরের অবস্থান পরিষ্কার করে দেয়Ñ সংকট গভীর হলে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, সন্দেহ জাগে, এটি নির্বাচন প্রলম্বিত করার একটি অপচেষ্টা কি না। দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন না করাতেই সংকট তৈরি হয়েছে।
তার মতে, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দুই পথেই দলগুলোকে আস্থায় এনে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা সরকারের দায়িত্ব।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হওয়া সংকট এখন চরম পর্যায়ে। দলগুলোর মধ্যে আস্থা নেই, কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে, সরকারের ওপর সক্রিয় চাপ বাড়ছে আর আগামী নির্বাচন সময়মতো হবে কি নাÑ সেটিও অনিশ্চয়তায় ঘেরা।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়সীমা শেষ হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবেÑ তা নির্ধারিত হবে দলগুলোর সিদ্ধান্তে, সরকারের প্রতিক্রিয়ায় এবং কমিশনের সিদ্ধান্তের পরবর্তী পদক্ষেপে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের চোখ এখন আগামী কয়েক দিনের ওপরই নিবদ্ধ থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
গত ৪ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের সভা থেকে দলগুলোকে সাত দিনের যে সময় দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল মূলত দলগুলোকে আলোচনায় এনে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার করার একটি প্রচেষ্টা। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীÑ এই দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে আর দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাব এতটাই গভীর যে আলোচনার টেবিলেই বসা হয়নি।
বিএনপি জানিয়েছে, তারা জুলাই সনদ সংক্রান্ত কোনো আলোচনা অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে করবে না। তাদের অভিযোগÑ সংকট দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ থেকে জন্মায়নি, বরং সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ‘একপাক্ষিক পদক্ষেপ’ থেকেই এর সৃষ্টি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, সরকার ও কমিশন সমস্যা তৈরি করেছে। তারা আলোচনা করতে চাইলে আমরা বসব। অন্য দলগুলোর সঙ্গে আমাদের কেন আলোচনা করতে হবে?
বিএনপির অভিযোগ, কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে, তা ‘একতরফা’ এবং দলগুলোর আলোচনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেওয়া হয়েছে, যা দলগুলোর সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে। সুপারিশে এমন কিছু বিষয় রাখা হয়েছে যা নিয়ে কমিশনের সভায় কোনো আলোচনা হয়নি।
বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হওয়া উচিত এবং নির্বাচন অবশ্যই ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত করতে হবে।
এদিকে জামায়াত বলছে, কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে তা অবিলম্বে বিশেষ সরকারি আদেশের মাধ্যমে আইনি রূপ দেওয়া উচিত। তাদের দাবিÑ গণভোট অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত হতে হবে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলছেন, সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। আদেশ জারি করে গণভোট দিলে সমাধান হয়ে যায়। এত দেরি কেন?
জামায়াত অভিযোগ করছে, সরকার দলগুলোর ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত দেখাতে চাইছে। কমিশন যে নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়েছে, তা সংকট তৈরির প্রধান কারণ। কিছু দলকে সুবিধা দিতে সরকার এই প্রক্রিয়াকে গোপনে রাজনৈতিকভাবে পরিচালনা করছে। ১১ নভেম্বর জামায়াত ঢাকায় সমাবেশ ডেকেছে, যেখানে দাবি মানা না হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদে সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করে। কিন্তু পরে কমিশন যখন তাদের সুপারিশ সরকারকে দেয়, দলগুলো অভিযোগ করেÑ আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ গেছে। আলোচনায় ছিল না এমন বিষয় যুক্ত হয়েছে। নোট অব ডিসেন্ট দেখানো হয়নি।
সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে গণভোটের সময় ও সাংবিধানিক সংস্কার পদ্ধতি নিয়ে। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছেÑ সরকার বিশেষ আদেশ জারি করে গণভোট করবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। নির্ধারিত সময়ে সংস্কার না হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।
বিএনপি এই ধারা ‘অসাংবিধানিক’ বলে দাবি করেছে। জামায়াত বলছে, এটাই সঠিক পদ্ধতি। দলগুলোর ঐকমত্য না হওয়ায় সরকার গণভোটের তারিখ ঠিক করবেÑ এ সুপারিশও দুই দলের অবস্থানকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
সময়সীমার মধ্যেও দলগুলো আলোচনায় বসতে না পারায় রাজনৈতিক মহল এখন স্পষ্ট বলছেÑ বাংলাদেশের রাজনীতি কার্যত দুই বলয়ে বিভক্ত। বিএনপি সমর্থক বলয় বলছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট সঙ্গে, নোট অব ডিসেন্ট রাখতে হবে। জামায়াত সমর্থক বলয় বলছে, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হতে হবে। কমিশনের সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়ন। সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যুক্ত করার দাবি। যা দল দুটির মধ্যের বিভাজন, সমঝোতার পথকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
এদিকে গণতন্ত্র মঞ্চ আলাদাভাবে বিএনপি ও জামায়াতÑ দুই দলের সঙ্গেই আলোচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম জানিয়েছেন, ইতিবাচক সাড়া এখনো পায়নি। তবুও চেষ্টা অব্যাহত আছে। এ থেকে স্পষ্টÑ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রোধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সহকারি সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, পরিস্থিতি যাই হোক শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকেন্দ্রিক হয়ে যাবে। এখন যে অচলাবস্থা চলছে তা এক প্রকার চাপ তৈরি করা। এই চাপ তৈরি করে তারা নিজ নিজ সুবিধা আদায় করে নিতে চাইছে। যাতে রাজনীতিতে তারা সুবিধা আদায় করে নিতে পারেন।

