গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার শত বছরের পুরোনো নৌকার হাটগুলো আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মাছের ঘের, সরকারি খাল ও জলাশয়ের অবৈধ দখল আর প্রকৃতিগত পরিবর্তনের কারণে নৌকা ব্যবহার আগের মতো নেই বললেই চলে। ফলে ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাটগুলো হারাচ্ছে চিরচেনা কোলাহল ও ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়।
একসময় যেখানে শত শত নৌকা নিয়ে বিক্রেতারা আসতেন, সেই হাট এখন নীরব আর নির্জন। হাতে গোনা কয়েকজন বিক্রেতা বসে থাকলেও নেই ক্রেতাদের ভিড়, নেই হাঁকডাক বা দরদামের স্বাভাবিক দৃশ্য। আগে যেখানে প্রতিটি হাটে ৫০-৬০টি নৌকা বিক্রি হতো, এখন হয়তো মাত্র তিন-চারটি নৌকা বিক্রি হয়।
নৌকা বিক্রেতা গোপাল ঘরামী বলেন, ‘কাঠ, লোহা আর শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এখন আমাদেরও বেশি দামে নৌকা বিক্রি করতে হয়। ফলে আগের মতো বিক্রি হয় না। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো আর কিছুদিন পর নৌকার হাটই থাকবে না।’
নরেশ বাড়ৈ নামে এক স্থানীয় ক্রেতা বলেন, ‘আগে সুন্দরী ও লোহা কাঠের নৌকা কিনতাম, যা ১৫-২০ বছর পর্যন্ত টিকত। এখন রেইন্ট্রি বা মেহগনি কাঠের নৌকা এক বছরও টেকে না। তাই প্রতিবছর নতুন নৌকা কিনতে হয়। তার ওপর এ বছর নৌকার দামও অনেক বেশি।’ ফলে স্থানীয়দের মধ্যে নৌকা কেনার আগ্রহ যেমন কমেছে, তেমনি বিক্রেতারাও আগের মতো নৌকা তৈরি করছেন না।
একসময় ঘাঘর নৌকার হাট ঘিরে নদীকেন্দ্রিক এক জীবন্ত সংস্কৃতি ও উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হতো। বিক্রেতারা গান গাইতে গাইতে নৌকা বেয়ে হাটে আসতেন, ক্রেতারাও কেনা নৌকা নিয়ে গানে গানে ফিরে যেতেন। এখন সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। নৌকা আনা-নেওয়া হচ্ছে ভ্যানগাড়ি বা ট্রাকে করে।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী সজল বালা বলেন, ‘এটা শুধু বাণিজ্য নয়, আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় অংশ ছিল। এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই দুঃখজনক। ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর দখল আমাদের ঐতিহ্যকে হত্যা করছে। এটার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, অপরিকল্পিতভাবে মাছের ঘের তৈরি, খাল-বিল ভরাট ও জলাশয়ের দখল নৌকার চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। আগে যেখানে নৌকায় চড়ে সহজেই হাটে যাওয়া যেত, এখন সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে ঘের বা দালান। ফলে নৌকা ব্যবহার কমে গেছে, মানুষও নৌকা কেনা বন্ধ করেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘নৌকা এই জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। সময়ের সঙ্গে নৌকার ব্যবহার কমে গেলেও যদি কেউ নৌকা তৈরি বা ব্যবহার বাড়াতে চায়, উপজেলা প্রশাসন তাকে সহযোগিতা করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে মাছের ঘের তৈরি ও খাল-বিল দখলমুক্ত করতে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’