চব্বিশের ছাত্র-জনতার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তথা জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে আগামী মঙ্গলবার। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখেই পতন হয় শেখ হাসিনার তথা ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগের। এই আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল ‘প্রযুক্তি’।
আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচির পরিকল্পিত বাস্তবায়ন ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গঠনে প্রযুক্তির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। অন্যদিকে, আন্দোলন দমাতে প্রযুক্তির ব্যবহারেও পিছিয়ে ছিল না তৎকালীন আওয়ামী প্রশাসন। প্রতিবাদী জনতাকে রুখে দিতে একপর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা।
তবে শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার জীবন বাজি রাখা আন্দোলনের মুখে পালাতে বাধ্য হন তিনি। উত্তাল সেই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া তরুণরা বলছেন, আন্দোলনের সফলতার পেছনে প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মগুলো বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
জুলাই অভ্যুত্থ্যানে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীরা বলছেন, নিরাপদ ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গঠনে অন্যতম সহায়ক ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগনালের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ করতেন তারা।
আন্দোলনকারীদের সংঘবদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এসব প্ল্যাটফর্ম। পাশাপাশি আন্দোলনের পক্ষে এবং ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে জনমত গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল প্রযুক্তি মাধ্যমগুলোর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখসারীর যোদ্ধা আবু বাকের মজুমদার ইনফোটেককে বলেন, ‘আন্দোলনে সব স্তরের মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো খুবই কাজে লেগেছিল। যেমন বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি (সোশ্যাল মিডিয়া) গ্রুপ ছিল, যার মাধ্যমে আন্দোলনকে সংগঠিত করা হয়েছিল। সিনেমাটোগ্রাফি, ফটোগ্রাফির মতো প্রযুক্তি আন্দোলনে আমাদের খুব সহযোগিতা করেছে। ৬-৭ জুলাই থেকে এই আন্দোলনের সঙ্গে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে শুরু করে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমরা সচেতনভাবেই আন্দোলনের ছবি-ভিডিও স্কুল-কলেজের গ্রুপগুলোয় প্রকাশ করা শুরু করি। এটা একটা উদাহরণ বললাম- কিন্তু এভাবেই প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বয়ান বা দৃষ্টিভঙ্গি দেশে ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিতে প্রযুক্তি কাজ করেছে। অন্যদিকে আন্দোলনে অংশ নেওয়া আমরা নিজেদের মাঝে যোগাযোগে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছি। যখন বুঝলাম যে মোবাইলে আঁড়িপাতা হচ্ছে, তখন ‘টেলিগ্রাম’ (তাৎক্ষণিক বার্তা আদান প্রদানের মাধ্যম) এবং শেষ পর্যায়ে ‘সিগনাল’ (মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম) ব্যবহার শুরু করি। এর আগে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামসহ আমাদের রাডারে যা ছিল, সব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছি। এতে নিজেদের মাঝে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল।’
জুলাই আন্দোলনে আধুনিক বা প্রচলিত সব ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের উদাহরণ তুলে ধরে অভ্যুত্থানের আরেক যোদ্ধা ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখার সভাপতি ইভান তাহসীব বলেন, ‘আন্দোলনে সবাইকে সংগঠিত করার বড় কাজটা করেছে প্রযুক্তি। ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় যখন ‘নিউ মিডিয়া’ বন্ধ ছিল, তখন কিন্তু আমরা পুরোনো প্রযুক্তিও ব্যবহার করেছি যেমন টেক্সট মেসেজ (এসএমএস)। একদিন আসল যখন আন্দোলনে ৯ দফা নাকি ৮ দফা, সে নিয়ে টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু উচ্চপর্যায় থেকে যখন ৯ দফা নিশ্চিত করা হলো, তখন টেক্সটের মাধ্যমে সেই বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।’
বর্তমান প্রজন্ম যে স্মার্টফোনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে না বরং তা ব্যবহার করে প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের মসনদ ফেলে দিতে পারে, তার দৃষ্টান্ত জুলাই আন্দোলন। ইভান তাহসীব বলেন, ‘এই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করেছে। খুব স্বল্প সময়ে আন্দোলনকে বেগবান করা গেছে প্রযুক্তির কল্যাণে। কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় ভয়াবহতা বেশি, কোথায় যেতে হবে- এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া গেছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এবং সেই সিদ্ধান্ত ছড়িয়েও দেওয়া হয়েছে এসব মাধ্যমে। শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্রকে যে হারাতে পারলাম, সেটা সামাজিক মাধ্যম তথা প্রযুক্তির জন্য সম্ভব হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মিমস শেয়ার করা হয়েছে। এমন অনেক মিমস, ছবি, ভিডিও শেয়ার করা হয়েছিল যার মাধ্যমে অনেক কিছু না বলেও যেন সবকিছু বলা হচ্ছিল। এই জেনারেশন যে ডিজিটাল কনটেন্ট দেখে বড় হয়েছে, সেগুলো দিয়েই আন্দোলন করেছে।’
জুলাই আন্দোলনে প্রযুক্তি যে শুধু আন্দোলনকারীরা ব্যবহার করেছে বিষয়টা এমন না। আন্দোলন দমনে হাসিনা বাহিনীর দ্বারাও প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে। মোবাইল সিমের জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্তে, তাদের মধ্যকার কথোপকথন শুনতে, এমনকি ড্রোনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের জমায়েতের চিত্র বুঝতেও প্রশাসন প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে। এছাড়াও আন্দোলনের বিপক্ষে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিতেও ব্যবহৃত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এজন্য নানান প্রলোভনে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদেরও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে প্রযুক্তির সচেতন ব্যবহার শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের পক্ষে ছিল।
এ বিষয়ে আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘জুলাই মাসে আন্দোলনের বিপক্ষে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন বয়ান দিচ্ছিল। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমও অনেকাংশে তাদের সাহায্য করে। আওয়ামী লীগের এই বয়ানের বিরুদ্ধে আমাদের জনমত গঠনে এবং সেটি ছড়িয়ে দিতে প্রযুক্তি সাহায্য করেছে। আওয়ামী লীগের বয়ান অনলাইনে খণ্ডন করতে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম, আর সেটি সম্ভব হয়েছিল শুধু প্রযুক্তির কারণে।’