জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার পর তখন অনেক ক্যাম্পাসকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণাও দিয়েছিলেন তারা।
তবে গত শুক্রবার রাতে আন্দোলনের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণার পর ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না সেই প্রশ্নটি আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের আগে হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই আন্দোলন করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। বরং সুষ্ঠু ধারার রাজনীতিই এ সংকটের সমাধান করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডাকসুর আচরণবিধি প্রণয়ন ও সংশোধন বিষয়ক কমিটির সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস মনে করেন, ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখেই এখন নানা ইস্যু উঠে আসছে এবং হলে ছাত্ররাজনীতির ইস্যু সামনে এনে কর্তৃপক্ষ ‘কোনো কোনো সংগঠনকে’ বিশেষ সুবিধা দিতে চাইছে।
গত শুক্রবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাবি হল শাখার বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করে ১৮টি হলে ৫৯৩ জন শিক্ষার্থী দিয়ে নতুন আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও হল পর্যায়ে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেনÑ ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, হল পলিটিকস নো মোর’। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়া থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসিতে এসে জড়ো হন তারা।
রাত ১২টার দিকে রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান শেষে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। রাত দেড়টার দিকে উপাচার্য বেরিয়ে এলে আন্দোলনকারীরা ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন। দীর্ঘ বাগবিত-ার পর রাত পৌনে ৩টার দিকে হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদ, প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ, প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ ফারুক শাহ।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে উপাচার্য বলেন, আমরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে ১৭ জুলাইয়ের সেই অবস্থানে আছি।
তবে ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে হলগুলোতে ছাত্রসংগঠনগুলো আচরণবিধি অনুসরণ করছে কি না তাতে তোমাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রয়োজন। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
উপাচার্যের ওই বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা ‘না, না’ বলে আপত্তি জানান ও হলগুলোতে সম্পূর্ণভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করেন। তারা হলে হলে শিবিরের গুপ্ত কমিটির প্রকাশ্য ও ছাত্রদল কমিটির সদস্যদের শাস্তির দাবিও জানান।
আন্দোলনটি ৫ দফা দাবিতে রূপ নেয়। দাবিগুলো হলোÑ ১৭ জুলাই ২০২৪ সব হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ছাত্রদলের কমিটি প্রকাশ পাওয়ার ১২ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও প্রশাসন দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য তাদের জবাব দিতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছাত্রদল, শিবির, বাগছাস, বামসহ যেসব দলের হলে গুপ্ত ও প্রকাশ্য কমিটি আছে, সেসব কমিটি বিলুপ্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও একাডেমিক এলাকায় রাজনীতির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে ছাত্ররাজনীতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব হল কমিটি বিলুপ্ত না করা হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে ও সব হলের প্রভোস্টদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি যেন আর কখনো স্বৈরাচারী হয়ে ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি হলে শিক্ষার্থী এবং প্রশাসনের মধ্যে লিখিত চুক্তি সই হয়েছিল, হলগুলোতে আর কখনো রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে না এসেও হলগুলোতে ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের গুপ্ত কমিটিকে কার্যকর করেছে।
পরে ছাত্র ইউনিয়নও হল কমিটি ঘোষণা করে। সর্বশেষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তাদের হল আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা শঙ্কিত যে, হলগুলোতে আবার গণরুম ও গেস্টরুমের সংস্কৃতি ফেরত আসবে।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শামীম হোসেন বলেন, গত বছরের ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। কিন্তু এরপরও প্রথমে বাগছাস এবং ছাত্রশিবির গুপ্ত রাজনীতি শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় আজ (শুক্রবার) ছাত্রদল কমিটি দিয়েছে, যার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতি চালু হয়ে গেল।
শামীম হোসেন বলেন, আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি, এটা জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রকাশ্য বেইমানি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেভাবে ছাত্রলীগকে হল থেকে বিতাড়িত করেছে, সেভাবে সব দলকেই একদিন বিতাড়িত করবে।
এদিকে ঢাবির হলে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনীতি ছাড়া অন্য সব দলের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানানোর অভিযোগ উঠেছে বামপন্থি ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক সদস্যসচিব ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও মুখপাত্র উমামা ফাতেমার বিরুদ্ধে। কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষকে দেওয়া দরখাস্তে উমামা ফাতেমা লেখেন, ‘কবি সুফিয়া কামাল হলে আমরা গত বছরের ১৭ জুলাই সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসন থেকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিতে সমর্থ হই যে, সুফিয়া কামাল হলে সব ধরনের রাজনীতি (ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, শিবির, বাগছাস) নিষিদ্ধ থাকবে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সিনেটে সরকার মনোনীত শিক্ষাবিদ সদস্য অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, শুধু আবাসিক হল নয়, পুরো ক্যাম্পাসে গুপ্ত, লুপ্ত, সুপ্ত, বিলুপ্ত সকল প্রকার দলীয় ছাত্র কিংবা শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। অথচ আমরা কী দেখছি? রঙের আবরণে দলীয় শিক্ষক রাজনীতি পুরোদমে চলছে।
আমরা চাই ক্যাম্পাস হবে মুক্তচিন্তার চারণভূমি। ছাত্ররা যদি দলীয় রাজনীতি পরিহার করে তার অনেক সুফল আছে। হলে টর্চার সেল থাকবে না। হলগুলো পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজন হবে না। কয়েকজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় ছাত্ররাই পার্টটাইম চাকরি হিসেবে আবাসিক হলগুলো পরিচালনা করতে পারবে। শুধু আবাসিক হল কেন, ছাত্ররা রেজিস্ট্রার ভবন, লাইব্রেরি প্রভৃতি জায়গায়ও পার্টটাইম চাকরি করতে পারবে। এটাই সারা পৃথিবীর স্বাভাবিক ক্যাম্পাসের চিত্র। এর মাধ্যমে ছাত্ররা দায়িত্ববোধ, নেতৃত্ব ইত্যাদি শিখবে।