বিতর্কিত ইউটিউব চ্যানেল ‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক আর্থিক সজীব ও অভিনেত্রী শায়লা সাথীর বিরুদ্ধে ওঠা অনৈতিক ও পেশাগত অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই বিতর্কের রেশ না কাটতেই এবার একে একে মুখ খুলছেন চ্যানেলটির সাবেক সদস্যরা।
তারা কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বার্তায় বা শো-এর মাধ্যমে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তবে ‘প্র্যাঙ্ক কিং’ টিমের বেশিরভাগ সাবেক সদস্যদের কাছে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন।
তাদের অভিযোগ, শায়লা সাথী ও সজীবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে টিমে পক্ষপাতিত্ব ও অবহেলার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এমনকি কোনো কারণ না দেখিয়ে সদস্যদের বাদ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে জানিয়েছেন তারা।
‘প্র্যাঙ্ক কিং’ শুরুর দিকে আর্থিক সজীব পরিচালক মামুনুর রশিদের হাত ধরে শুরু করেছিলেন এ যাত্রা। শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন সজীব, এমনটাই অভিযোগ মামুনের।
পরে টিম থেকে বের হয়ে যান জানিয়ে মামুন বলেন, ‘সাথী টিমে আসার পর এমন অবস্থা হয়েছে যেন সে ‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এর মালিক। টিমে সাথীর প্রভাব প্রচুর। সাথী প্রথমে যেভাবে আমাকে সম্মান করতো, পরে আর তা পাইনি। সজীবকে সবার সামনেই গালি দিত সাথী, যা টিমের অন্য কেউ করত না।’
প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘সাথী-সজীব ঢাকার এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় একান্ত সময় কাটাতো। সজীব টিএসসিতে যে সময় এক্সিডেন্ট করল, তখন সাথীকে আনতে গিয়েছিল। সাথী যদি তার বোন হয় তাহলে টিমে আরোহী মিমসহ অনেক বোন আছে তার, তাদের কোনদিন আনতে যায়নি কেন?’
মামুন আরো বলেন, ‘সজীব অন্য কারো শুটিং দেখতে কখনো কোথাও যায় না। কিন্তু সাথীর শুটিং বাংলাদেশের যে প্রান্তেই হোক না কেন, সেখানে সে যেত। সাথী ২৪ ঘণ্টা রাগ করে থাকে, সেই রাগ ভাঙ্গানোর জন্য সজীব তার পেছনে লেগেই থাকত। সাথীর জন্যই সবাই আজ ভুক্তভোগী।’
আর্থিক সজীবের দূর সম্পর্কের আপন ভাগ্নি সামিয়া সুলতানা। প্রথম পাঁচ বছর তার বাসাতেই বিনা পয়সায় শুটিং করেছেন তিনি। এবার সেই ভাগ্নিও মুখ খুললেন। তিনি বলেন, ‘একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি দেখেছি, সজীব মাঝে মাঝে বাসায় নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে আসত। দিনের বেলাতেই নয়, রাতেও দরজা বন্ধ করে সময় কাটাতো। তবে সেই মেয়েদের দিয়ে কাজ করাতো না। আমি তাদের কয়েকজনের নামও বলতে পারব। শুরুর দিকে টিমের কারও সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক চোখে পড়েনি, তবে পরে অনেকের কাছ থেকে নানা কথা শুনেছি। সাথীর সঙ্গেও শুরুতে সম্পর্ক ছিল সবার মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু ওর প্রতি এক ধরনের ‘এক্সট্রা কেয়ার’ শুরু থেকেই লক্ষণীয় ছিল। সাথীকে আমার বাসায় রাখার প্রস্তাব, ডাক্তার দেখানো, এমনকি তার বাবাকে ডাক্তার দেখানো-সব সমস্যায় পাশে থাকা-এসব আমি অন্য কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে কখনও দেখিনি। এই অতিরিক্ত যত্নই পরে প্রেমে রূপ নেয়।’
‘প্র্যাঙ্ক কিং’ টিমে নতুন যুক্ত হয়েছিল অভিনেত্রী সানজিদা আলম। সাথীর কারণেই দুইটি নাটকের পর টিকে থাকতে পারেননি টিমে। তিনি বলেন, ‘শুটিং সেটে সাথীর সম্মান সবচেয়ে বেশি থাকে। আমাদের একটা নাস্তা দিলে তাকে আলাদা ভিআইপি নাস্তা দেওয়া হয়। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম সাথী সিনিয়র শিল্পী। তাই অনেক সম্মান করতাম, তাকে সালাম দিতাম। হঠাৎ তিনি আর আমার সালামের উত্তর দেন না। তাই একদিন সালাম না দেওয়ার কারণে ৪-৫ ঘণ্টা শুটিং বন্ধ করে রেখেছিল সাথী। পরে সেই শুটিং সেটে আমাকে নিয়ে বিচার বসিয়েছিল। সাথী আমাকে বলেছিল, ২ টাকার শিল্পী কোথা থেকে ধরে আনো, এইগুলোকে বের করো না কেনো, যা ইচ্ছে তাই।’
শুটিং সেটে সাথীকে সুন্দর মেকআপ করতে হবে এবং অন্যদের কালো মেকআপ। তার মতে, ‘সহশিল্পীকে কোনভাবেই সুন্দর দেখা যাবে না। শুটিং সেটে তার প্রভাবে টেকাই যায় না। ডিরেক্টরসহ সম্পূর্ণ সেটের মানুষ সাথীর কথায় ওঠাবসা করে।’
সানজিদা আরও বলেন, ‘আমি প্রথমে সজীব ভাইকে চিনতাম না, তাই প্রথমদিকে মনে করেছিলাম সাথী সজীব ভাইয়ের কাজিন অথবা বয়ফ্রেন্ড। একবার, সাথী সজীব ভাইকে ব্লক করেছিল, আনব্লক করার জন্য সেটে যা করেছিল সজীব ভাই, তা বলার মত নয়। আমার সাথে অকারণে অবিচার করা হয়েছে।’
‘প্র্যাঙ্ক কিং’ শুরুর দিকে যুক্ত ছিলেন অভিনেত্রী নাসিমা খান প্রিমা। সম্প্রতি তিনিও ফেসবুকে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেন, ‘একদিন শুটিং সেটে আমার জুনিয়র নারী আর্টিস্ট আমার সঙ্গে বেয়াদবি করে, পরে বিষয়টি আমি সজীবকে জানালে সে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো প্রশ্রয় দিচ্ছে। ‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এর অনেক শিল্পীর টাকা আত্মসাৎ করে বাড়ি-গাড়ি করেছে সজীব। আমার পারিশ্রমিক আজও দেয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এতদিন জানতাম সজীব শিল্পীদের টাকা আত্মসাৎ করে, কিন্তু সজীবের চরিত্র এত খারাপ এটা আগে জানতাম না। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে কিছু কথা আছে, সেটাই হচ্ছে। যা হয় তা কিছুটা হলেও তো ঘটে। আল্লাহ ছাড় দেয়, ছেড়ে দেয় না। মানুষের সঙ্গে খারাপ কাজ করলে তার সঙ্গে কখনো ভালো কাজ হয় না।’
এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন অভিনেতা ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সজীব ভাই সাথী আপুকে অন্যান্যদের থেকে প্রায়রিটি বেশি দেয়। এটা সেটের সবাই দৃষ্টিকটু হিসেবে দেখতো। একটি টিমের সবাইকেই ভালো গল্প দেওয়া উচিত, কিন্তু সজীব ভাই তা করে না। ভালো গল্পগুলো সাথী আপুকে দেয়। এ বিষয়টি নিয়ে আমি সজীব ভাইকে অভিযোগ করে বলেছিলাম, কিন্তু তিনি বিষয়টি আর দেখেন না। এ সকল ঝামেলার জন্যই আমি এই টিম ছেড়ে দিয়েছি।’
এ প্রসঙ্গে অভিনেতা সিয়াম মৃধা বলেন, ‘সাথী এবং আমার বাসা একই জেলায় হওয়ায় আমরা খুব ভালো বন্ধু। এটা সজীব ভাইয়ের সহ্য হতো না। এ কারণে একবার আমার শুটিং সেটে সজীব কিছু বখাটে ছেলে ভাড়া করে হামলা করায়। এছাড়া আমার কাজ মুক্তি দিতে বাধা দিতো এবং কয়েক মাস কাজই বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি যে বাইরে কাজ করব সেই অপশনও রাখেনি। সব চ্যানেলে বলতো আমাকে কাজে নেওয়া যাবে না। সাথীর সাথে কথা বলতে নিষেধ করত সজীব। মাঝে মাঝে এর জন্য আমাকে থ্রেট দিতো।’
এক ঘটনার উল্লেখ করে সিয়াম বলেন, ‘একবার সজীব আমার ফোন জোর করে কেড়ে নিয়ে সাথীর সাথে ফেসবুক মেসেঞ্জারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢুকে কথোপকথন দেখেছে। পরেরদিন আমাকে অফিসে ডেকে সাথীর সঙ্গে কথা বলতে ফের মানা করেন। সজীব এক মাসে যদি অন্যদের দুইটি কাজ দিতো, সেখানেই সাথীকে কাজ দিত চারটি। বাধ্যতামূলক সকলের সহ শিল্পী হিসেবে সাথীকেই রাখা হতো। গল্পগুলো সব সাথী কেন্দ্রিক হতো। সজীবের টান থাকতো সাথী উপর।’
এ প্রসঙ্গে ‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এর সাবেক কণ্ঠশিল্পী জাকিয়া সুলতানা স্বর্ণলতা বলেন, ‘আমি ‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এ কয়েকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছি। আমার সঙ্গে সজীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সম্পর্ক ছিল সে সময়ে। একদিন মুঠোফোনে সজীব আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। ফোন করে আমাকে বলে, তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই, তুমি আমার বন্ধু হয়ে যাও, প্রেম বাদে আমরা সব কিছু করব। শুধু প্রেমটাই থাকবে না, বাকি সব হবে আমাদের মধ্যে। তার এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় পরবর্তীতে তিনি আমাকে টিম থেকে বাদ দিয়ে দেন।’
অভিনেত্রী তিথি এর আগে একটি ইউটিউব চ্যানেলের শোতে সজীব ও সাথীকে নিয়ে তার টিমের সদস্যদের করা একই ধরনের অভিযোগ এবং নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।
রূপালী বাংলাদেশকে তিথি বলেন, ‘বিনা পেমেন্টে, নিজের ভাড়া দিয়ে, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে টিমের জন্য কাজ করেছি। সাথী আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করত। সাথীর ষড়যন্ত্রের জন্য টিম থেকে চলে গিয়েছিলাম। পরে যখন টিমে ফেরার ইচ্ছা জানালাম, তখন চার মাস ধরে নানা অজুহাতে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, শুধুমাত্র সাথীর জন্য। কারণ সাথী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী চায় না। আমি যখন টিমে ছিলাম, তখন সাথীর তেমন কোনো বেল ছিল না।’
তিথির এই অভিযোগগুলো ছাড়াও টিমের অন্যান্য সাবেক সদস্যরাও সাথীর একচ্ছত্র আধিপত্য, পক্ষপাতমূলক আচরণ ও সদস্যদের অবমূল্যায়নের বিষয়ে একই রকম অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সাথী ও সজীব দাবি করেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য নয়। তাদের নাম উল্লেখ করে অন্যরা ভাইরাল হতে চায়।