পিলখানা হত্যাযজ্ঞের তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর থেকে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের শীর্ষ মহলে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লিখিত ঘটনার পেছনে পুলিশ ও র্যাব এবং রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও রয়েছে চরম ব্যর্থতা। ওই সময় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) দায়িত্বে থাকা এবং বর্তমান আইজিপি বাহারুল আলমকেও এ ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। আলোচিত এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত একজন ব্যক্তিকে পুলিশের শীর্ষ পদে বহাল রাখাটা কতটা যৌক্তিক, সেটা নিয়েই শুরু হয়েছে তোলপাড়।
বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সচিবালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র থেকে বিরাজমান এই পরিস্থিতির কথা জানা গেছে। সূত্র মতে, যেকোনো মুহূর্তে আইজিপি পদ থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে আইনের আওতায় আনা হবে। বাহারুলের এক মেয়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাকেও সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে গুরুতর মন্তব্য এসেছে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় বাহারুল আলম ছিলেন এসবি প্রধান। বাহারুল বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। পিলখানার ঘটনার পরপরই তাকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানো হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরের শান্তিরক্ষা বিভাগে পুলিশ লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের সিনিয়র পুলিশ অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করেন। ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, কসোভো ও সিয়েরা লিওনেও দায়িত্ব পালন করেন বাহারুল আলম। ২০২০ সালে তিনি অবসরে যান।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০ নভেম্বর তাকে চুক্তিভিত্তিক আইজিপি করা হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের ১৪৬ নম্বর পয়েন্টে পুলিশের পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম এসেছে। অন্যরা হচ্ছেন- তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদ, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার নাইম আহমেদ, সাবেক (পলাতক) অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, বিডিআর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র মতে, প্রতিবেদনে বাহারুলের নাম আসাতে সত্যিকার অর্থেই একটা বিব্রতকর অবস্থা দেখা দিয়েছে। পদস্থ পর্যায়ে আলোচনা চলছে, পরবর্তী করণীয় নিয়ে। একটি মহল বলছে, তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আরেকটি মহল বলছে, আইজিপি পদ থেকে তাকে সরিয়ে কোথাও রাষ্টদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তবে, এই পক্ষের সংখ্যা খুবই কম। তবে সিদ্ধান্ত যেটাই হোক, মন্ত্রণালয় ভাবছে আইন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এটি কার্যকর করতে। এ বিষয়ে শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে একাধিক সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছে।
মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা গতকাল টেলিফোনে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কমিশনের একটি স্পর্শকাতর প্রতিবেদনে আইজিপির নাম আসার পর থেকেই প্রশাসনের ভেতরে আলোচনা-সমালোচনা এবং তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)-তে দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্রিয় থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে— এমন বিতর্কিত অতীত থাকা একজন কর্মকর্তাকে জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা কতটা যৌক্তিক।
এ ছাড়া অবসরে চলে যাওয়া একজন ব্যক্তিকে আবার আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সময়ই অনেক প্রশ্ন উঠেছিলো। অনেকেই সেসময় বলেছেন, বিভাগে কি কোনো দক্ষ কর্মকর্তা নেই যে একজন অবসরে চলে যাওয়া ব্যক্তিকে আবার বহাল করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে তখন এই প্রশ্নটি জোরালো ভাবে দানা বাধতে পারেনি।
তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (এসবি প্রধান) বাহারুল আলম, কমিশনকে অনুমাননির্ভর তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের কর্মীদের ফাঁসিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি নেতা নাসিরুদ্দিন পিন্টুকে জড়িয়ে ছিলেন আইজিপি বাহারুল ইসলাম। পিলখানায় ঘটনার দিন জাহাঙ্গীর কবির নানক ও তাপসের লোকজন বিডিআরের পক্ষে মিছিল করে। সেই মিছিলে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীর ছেলে লেদার লিটন। অথচ ওই মিছিলটি নাসিরুদ্দিন পিন্টুর লোকজন করেছে বলে বাহারুল আলম তদন্ত কমিটিকে বলেন। সে সময় নাসিরুদ্দিন পিন্টুকে গ্রেপ্তারও করা হয় এবং পরবর্তীতে কারাগারে মারা যান তিনি। আনোয়ার হোসেন মাহবুব নামেও পিন্টু মুক্তি পরিষদের আরেক নেতাও (লালবাগ ভাট মসজিদ এলাকার) এর কয়েকদিন পর গ্রেপ্তার হন। পিন্টু এবং মাহবুব দুইজনই কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা যান।
কর্মকর্তা আরও জানান, বাহারুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, কমিশনের তদন্তে অনুমানভিত্তিক তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘটনায় সরকার বিরোধীদের ফাঁসানো, মিছিলকারীদের শনাক্ত না করে বিরোধী দলীয় কর্মীদের উপর দায় চাপানো, মিছিলকারীদের শনাক্ত না করা, এসবির তৎকালীন মাঠ পর্যায়ের টিমের পরিচয় না জানিয়ে এবং উক্ত টিম কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য প্রমাণা কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী প্রদান না করে কমিশনকে অসহযোগিতা করা।
স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তে পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে। তাদের মধ্যে আছেন বর্তমান আইজিপি বাহারুল আলমও। কেন তার নাম এসেছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণেই তার নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ জাতির সামনে প্রকাশ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করার।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম রুপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কমিশন তাদের কাজ করেছে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা সরকারের এখতিয়ার। এ নিয়ে আমার বলার কিছু নেই।’
এদিকে সচিবালয়ে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘মন্ত্রণালয় বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। প্রতিবেদনটি বড়, সব পড়া হয়নি। পুরো প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তাদের সুপারিশগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে।’
গত রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির পিলখানা হত্যাযজ্ঞে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৮ জন সেনা সদস্যসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরণ আইনের মামলায় ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। আরও অন্তত ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। তবে ঘটনার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন ভুক্তভোগীরা।
ঘটনার দেড় দশক এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর সাত সদস্যের জাতীয় স্বাধীন কমিশন গঠন করে সরকার। তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

