ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

সঙ্গী থাকলে শীতের তীব্রতা কমে কেন?

লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২৫, ০১:২৯ পিএম
ছবি- আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

শীতের সময় কুয়াশা, তীব্র হিমেল হাওয়া এবং হালকা তাপমাত্রা মানুষকে প্রায়শই শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। ঠান্ডা পরিবেশে বাইরে বের হওয়া অনেকের জন্য কষ্টদায়ক হয়, আর রাতগুলোও অনেক সময় একাকীত্বের অনুভূতিতে ঢেকে যায়।

তবে মনস্তাত্ত্বিক এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সম্পর্কিত বা বিবাহিত, তাদের শীতের তীব্রতা অনেকটা কম অনুভূত হয়। কেন এমন হয়, তা শুধুমাত্র রোমান্টিক কল্পনার ফল নয়; এর পেছনে রয়েছে জটিল মনোবিজ্ঞান এবং সামাজিক প্রভাব।

শারীরবিজ্ঞান: তাপমাত্রা ও সঙ্গীর প্রভাব

মানুষের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়ায় শুধু বাহ্যিক তাপমাত্রা নয়, মানসিক অবস্থা এবং সামাজিক সংযোগও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, সঙ্গীর উপস্থিতি শারীরিকভাবে কোর বডি টেম্পারেচার বা শরীরের মূল তাপমাত্রাকে কিছুটা বাড়াতে সাহায্য করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন মানুষ প্রিয়জনের কাছাকাছি থাকে, তখন শরীরে অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন শুধু মানসিক স্থিতিশীলতা দেয় না, বরং শরীরকে গরম রাখতেও সহায়ক। অক্সিটোসিন হরমোন স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে, যা রক্তনালীর প্রসার ঘটায় এবং তাপ ধরে রাখে।

আরেকটি প্রক্রিয়া হলো শরীরের ‘থার্মাল রেগুলেশন’। একজন সঙ্গীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ বা শরীরের ছোঁয়া শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা সংরক্ষণে সাহায্য করে। এমনকি সাধারণভাবে, হাতে বা পায়ের সংস্পর্শও রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে ঠান্ডা কম অনুভূত করে।

মনোবিজ্ঞান: একাকীত্ব বনাম সংযোগ

শীতকাল সাধারণত মানুষের মধ্যে মনোরোগ এবং বিষণ্ণতার প্রবণতা বাড়ায়। দিনে সূর্যের আলো কম, দিনের দীর্ঘ সময়, এবং রাতে দীর্ঘ নিঃশব্দ সময়, এগুলো একাকীত্ব বাড়ায়। একাকীত্বের ফলে মানুষ শীতকে বেশি কঠিন এবং অস্বস্তিকর মনে করে।

কিন্তু, যখন পাশে থাকে সঙ্গী, তখন মানসিক চাপ ও একাকীত্ব কমে যায়। মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং সেরোটোনিন হরমোন বৃদ্ধি পায়, যা সুখ এবং শান্তি অনুভূতিতে সাহায্য করে। সেই অনুভূতি মানুষের শরীরকে শারীরিকভাবে আরও বেশি তাপ ধরে রাখার অনুভূতি দেয়। সহজভাবে বললে, সঙ্গীর সান্নিধ্য শুধু হৃদয়কে নয়, শরীরকেও গরম রাখে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা সম্পর্কিত বা বিবাহিত, তারা শীতের সময় সামাজিক সমর্থন থেকে মানসিক শক্তি পায়। এই শক্তি কেবল আবহাওয়ার তীব্রতা সহ্য করতে সাহায্য করে না, বরং শীতকালকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।

সামাজিক আচরণ ও অভ্যাসের প্রভাব

শীতকালে অনেক মানুষ বাড়িতে বেশি সময় কাটায়। একা মানুষ প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটায় বা একা হবি অনুসরণ করে। কিন্তু সঙ্গী থাকলে মানুষ শীতকে উপভোগ্য করার জন্য একসাথে নতুন অভ্যাস তৈরি করে। যেমন: গরম চা বা কফি বানানো এবং একসাথে খাওয়া। শীতকালীন ঘরের সাজানো বা হোম ডেকোর প্রজেক্ট। একসাথে সিনেমা দেখা বা বই পড়া। শীতের হালকা হাইক বা হাঁটাহাঁটি। এসব অভ্যাস শুধু মানসিকভাবে উষ্ণতা দেয় না, বরং শারীরিকভাবে শরীরকে সক্রিয় ও গরম রাখে।

একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, যারা শীতের সময় একা থাকে, তারা শারীরিকভাবে আরও ঠান্ডা অনুভব করে এবং ঘরের ভিতরে গরম থাকা সত্ত্বেও শীতকে প্রায়শই কষ্টদায়ক মনে করে। অপরদিকে, সঙ্গী বা পরিবারের সঙ্গে থাকা মানুষ শীতকে আরামদায়ক ও আনন্দদায়ক মনে করে।

গবেষণা ও পরিসংখ্যান

যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিবাহিত বা সম্পর্কিত মানুষ শীতের সময় ২০% কম শারীরিক শীত অনুভব করে। এছাড়া, এই গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, যারা একা থাকে তারা গরম জামা বা হিটার ব্যবহার করলেও সঙ্গী থাকা মানুষের তুলনায় শীতকে বেশি তীব্র মনে করে।

অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, প্রিয়জনের সাথে শারীরিক সংস্পর্শ যেমন হ্যান্ডহেল্ড, আলিঙ্গন বা কোললাপ, শরীরের রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, যা হাড় ও ত্বককে গরম রাখে। এই প্রক্রিয়ায় স্নায়ুতন্ত্র ও হরমোন একসাথে কাজ করে।

মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্পর্কের গুরুত্ব

শীতের শারীরিক প্রভাব কমানোর পেছনে শুধু হরমোন বা রক্তসঞ্চালন নয়, মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যও গুরুত্বপূর্ণ। একজন সঙ্গীর সঙ্গে শীতকাল কাটানো মানুষের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও মানসিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়।

মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য শরীরকে আরও কার্যকরভাবে তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময়, সঙ্গীর উপস্থিতি রুমের তাপমাত্রা অনুভবকে বেশি আরামদায়ক করে।

বিভিন্ন সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতা

বিভিন্ন দেশে শীতকালীন উৎসব ও রীতি দেখায়, মানুষ প্রিয়জন বা পরিবারের সঙ্গে থাকাকে শীতের আনন্দের মূল হিসেবে দেখছে। যেমন:

ইউরোপের দেশগুলোতে, শীতকালে “কোল্ড নাইটস” উদযাপন করা হয় প্রিয়জনের সঙ্গে বসে গরম খাবার বা চা খেয়ে।

জাপানে, শীতকালীন হট স্প্রিং বা অনসেনে পরিবার বা সঙ্গীর সঙ্গে যাওয়া প্রচলিত।

বাংলাদেশে, শীতের সকালে একসাথে গরম চা বা কফি খাওয়া, শীতকালীন হাঁটাহাঁটি ও সক্রিয় সময় কাটানো পরিবার বা দম্পতির মধ্যে খুব জনপ্রিয়।

এগুলো প্রমাণ করে, শীতকালীন ‘গরম অনুভূতি’ শুধু ভৌত নয়, সামাজিক ও মানসিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সৃষ্ট।

প্রযুক্তি ও শীতকালীন সমাধান

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিও শীতের অনুভূতিতে প্রভাব ফেলে। স্মার্ট হোম হিটার, গরম ব্ল্যাঙ্কেট, হট ওয়াটার বোতল, এমনকি VR বা গেমিং অ্যাপ্লিকেশন মানুষকে শীতকালীন আরামদায়ক অনুভূতি দেয়। তবে গবেষণা বলছে, এগুলো শুধুমাত্র আংশিক সমাধান; সঙ্গীর সান্নিধ্য বা সম্পর্কের সাথে তুলনায় মানসিক উষ্ণতা কম।

শীতকাল একা কাটানো কষ্টদায়ক হতে পারে, কিন্তু প্রিয়জনের সান্নিধ্য শরীর ও মনের উষ্ণতা বজায় রাখতে সহায়ক। সঙ্গী থাকা শুধু হৃদয়কে নয়, পুরো শরীরকেও গরম রাখে। তাই শীতকাল উপভোগ্য করতে চাইলে সঙ্গী বা পরিবারের উপস্থিতি সবচেয়ে কার্যকর ‘প্রাকৃতিক হিটার’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।