ঢাকা সোমবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৫

বিটিআরসির কর্মকর্তাদের ওএসডির আদেশ

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৫, ০৭:১২ এএম
  • তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে তিন কমিটি
  • অন্তত ১৫ অযোগ্য কর্মকর্তা নিয়োগের প্রমাণ 
  • কর্মকর্তাদের ভাগ্য পরবর্তী কমিশনের সভায়

২০০৯ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) নিয়োগ পাওয়া ২৯ কর্মকর্তার মধ্যে অন্তত ১৫ কর্মকর্তার নিয়োগে অনিয়ম পাওয়া  গেছে। তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি পাওয়ারও প্রমাণ পেয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এ ছাড়াও আরও অন্তত ৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও চাকরি বিধিমালা ভঙ্গের প্রমাণ উঠে এসেছে তদন্তে। তিনটি পৃথক প্রতিবেদনে জমা দেওয়া তদন্ত কমিটির মতামত ও সুপারিশ আমলে নিয়ে, অভিযোগ প্রমাণিত কর্মকর্তাদের ‘বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ বা ওএসডি করার আদেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি তাদের ‘সাইনিং পাওয়ার’ তথা স্বাক্ষরের ক্ষমতাও প্রত্যাহারের আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বিটিআরসি বলছে, নিজস্ব নীতিমালা অনুসরণ করেই অভিযুক্তদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদিও সেই সিদ্ধান্তে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অগ্রাধিকার থাকবে বলে জানিয়েছেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী। 

২০০৯ সালে বিটিআরসিতে ২৯ জন কর্মকর্তার নিয়োগে অনিয়মের তথ্য জানা যায় ২০২১ সালে। সে বছরের জানুয়ারিতে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব মুহাম্মদ আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি অন্তত ১৫ কর্মকর্তার নিয়োগে অনিয়ম পেয়েছেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও ওই কর্মকর্তাদের বিটিআরসিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি পাওয়ারও অভিযোগ ওঠে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির তদন্তে, ৩ কর্মকর্তার অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা হলেন, উপপরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতি পাওয়া এয়াকুব আলী ভূইয়া, আফতাব মো. ওয়াদুদ এবং এম এ তালেব। পাশাপাশি ১৭ জন ড্রাইভার নিয়োগ এবং রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে জনবল কাঠামোবহির্ভূত, মঞ্জুরিবিহীন পদে নির্ধারিত ফির বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত পাঁচজন পরামর্শক ও প্রকল্পে কর্মরত ২৫ জনকে বয়স প্রমার্জন করে বিভাগীয় প্রার্থী ঘোষণা করে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ধরনের নিয়োগ ও পদোন্নতি ‘বিটিআরসির চাকুরি প্রবিধানমালা ২০০৯’ এর লঙ্ঘন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি। 

অন্যদিকে কমিশনের লাইসেন্সিং শাখার মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডু এবং দুই উপপরিচালক আসাদুজ্জামান ও শারমিন সুলতানার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে পৃথক আরেকটি তদন্ত কমিটি। মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডুর বিরুদ্ধে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। উপপরিচালক আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। আরেক উপপরিচালক শারমিন সুলতানার বিরুদ্ধে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত বিদেশ ভ্রমণেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। কর্মকর্তাদের এমন কর্মকা-ে বিটিআরসির প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়েছে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে কমিটি। 

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (টেলিকম) ও বর্তমানে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন পৃথক আরেকটি কমিটি বিটিআরসির পরিচালক এয়াকুব আলীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করে। অনিয়মের অভিযোগে বিভাগীয় তদন্তে দ- পেয়েও রাজস্ব বিভাগে স্বপদে বহাল ছিলেন পরিচালক এয়াকুব।

এতে বিটিআরসিতে শুদ্ধাচার চর্চার ঘাটতি হয় মর্মে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একই পদে এয়াকুব আলীর পদায়নে বিটিআরসির প্রশাসন বিভাগের মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার প্রমাণ উঠে এসেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এয়াকুব আলীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বিটিআরসি থেকে প্রত্যাহার করে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। 

পৃথক তিনটি কমিটির মতামত ও সুপারিশ আমলে নিয়ে গত ৩০ জুলাই বিটিআরসি চেয়ারম্যান বরাবর বিভাগের টেলিকম শাখার সিনিয়র সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এক চিঠি প্রেরণ করেন। এতে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া কর্মকর্তাদের ওএসডি করতে এবং স্বাক্ষরের ক্ষমতা প্রত্যাহার করতে বিটিআরসিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নির্দেশনা বলবত থাকবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। তবে ওএসডি ও স্বাক্ষরের ক্ষমতা প্রত্যাহারের নির্দেশনার আওতায় কোন কর্মকর্তারা থাকবেন, সে বিষয়ে চিঠিতে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক এখনো কোন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়নি বলেও জানা গেছে। 

অবশ্য বিটিআরসির নিজস্ব বিধিমালা অনুযায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলো অনেক পুরোনো এবং বিগত বছরগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে অডিট বিভাগের সাথেও আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে আসা এই নির্দেশনা আগামী কমিশন সভায় উত্থাপিত হবে এবং কমিশন সভায় যে সিদ্ধান্ত আসবে, সেই অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বিটিআরসির প্রতিনিধিত্ব ছিল না। বিটিআরসি থেকেও পৃথকভাবে তদন্ত হতে পারে এবং সেখানে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকবে। সিদ্ধান্ত যাই হোক, সেখানে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও প্রাধান্য পাবে’।