রংপুর বাংলাদেশের সেই বিভাগ যেখানে ইতিহাস শুধু ত্যাগ লিখেছে, প্রাপ্যতা অদৃশ্য রয়ে গেছে। কৃষক-শ্রমিক বিদ্রোহের পথপ্রদর্শক নুরলদীন, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ শঙ্কু সমঝদার এবং ’২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহিদ আবু সাঈদ, সবাই এই ভূমিরই সন্তান। তথাপি, আধুনিক বাংলাদেশে রংপুর শুধু এক ভোটব্যাংক রূপেই রয়ে গেছে। নির্বাচনের ছোঁয়া পড়ে, বাজেটের বরাদ্দ, অদৃশ্য।
সিন্ডিকেটের শিকল : রংপুরের অনুন্নয়ন
উপমহাদেশের এই বঙ্গভূমির ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমলে ঢাকা ছিল এক অবহেলিত শহর। কলকাতা ছিল তৎকালীন রাজধানী এবং প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ফলে ঢাকার উন্নয়ন প্রায় থমকে ছিল কলকাতার ‘সিন্ডিকেট’ বা স্বার্থচক্রের কারণে। কলকাতার ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিকদের কাছে ঢাকা ছিল কেবল একটি প্রাদেশিক শহর, তাদের নজর ও বিনিয়োগ ছিল হুগলি নদীর পাড়ে। তারা কখনোই চাইত না ঢাকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠুক, উন্নয়ন হোক- কারণ যদি এই পূর্ববঙ্গে উন্নয়ন সাধিত হয় তখন এখানকার টাকাওয়ালা-ব্যবসায়ী-মানুষেরা কলকাতায় যাবে না, তাদের ব্যবসা কিংবা অন্যান্য স্বার্থে ভাটা পড়বে। ফলে ঢাকার মানুষ উন্নয়নের জন্য হাহাকার করলেও, কলকাতার ক্ষমতার কক্ষপথ ভেঙে বের হতে পারেনি।
ইতিহাসের এই ছবিটা আজ যেন রংপুর বিভাগের জন্য নতুন করে আঁকা হচ্ছে, বরং তা এখন স্পষ্ট। পার্থক্য শুধু ভূগোলের, এখন ‘কলকাতার সিন্ডিকেট’ বদলে হয়েছে ‘ঢাকার সিন্ডিকেট’।
ঢাকার সিন্ডিকেটে বন্দি রংপুর
স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উন্নয়ন নীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা হয়ে উঠেছে। বাজেট, অবকাঠামো, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সব ক্ষেত্রেই ঢাকার দিকে ঢল। রাজধানীমুখী এই উন্নয়ন প্রবাহে রংপুর বারবার বঞ্চিত হয়েছে। সরকারি প্রকল্পগুলো হয় ঢাকাকেন্দ্রিক, নয়তো রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্য অঞ্চলে চলে যায়। ফলাফল, রংপুর পিছিয়ে পড়ে, এবং ক্রমেই ‘দারিদ্র্যের রাজধানী’ নামে কলঙ্কিত হয়।
ঢাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠী বা ‘সিন্ডিকেট’ দেশের সম্পদ বণ্টনের নিয়ন্ত্রণ রাখে। এদের চোখে রংপুর বড় কোনো অর্থনৈতিক বাজার নয়, বরং রাজনৈতিক প্রান্তিক অঞ্চল। যেখানে বিনিয়োগ করলে ঢাকায় থাকা ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর সরাসরি লাভ নেই, অথচ বসুন্ধরার মতো অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান রংপুরেরই। দক্ষিণাঞ্চলের সুবিধাবাদীররা এই অঞ্চলে বড় কোনো উন্নয়নে সহযোগিতা করে না, সরকারকেও বাধা প্রদান করে কারণ, এই অঞ্চল উন্নত হলে এখানকার যে বিশাল পরিমাণ জনগোষ্ঠী দক্ষিণাঞ্চলে কাজের জন্য যায়, তখন তারা রংপুরেই থাকবে ফলে তাদের উন্নয়নে ভাটা পড়বে, স্বার্থ ক্ষুণœ হবে। ফলে রংপুরের রাস্তাঘাট, শিল্পাঞ্চল, আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক উদ্যোগ বারবার স্থগিত হয় বা নামমাত্র অর্থায়ন পাচ্ছে।
ভোটের মাঠ, উন্নয়নের বঞ্চনা : তথ্য যা বলে
রংপুর আজ পরিণত হয়েছে কেবল ভোটের বাক্স হিসেবে। নির্বাচনের মৌসুমে রাজনৈতিক দলগুলো এখানে আসে প্রতিশ্রুতির ঝুলি নিয়ে, কিন্তু ভোটের পর সবকিছু মিলিয়ে যায়। এই অঞ্চল যেন ইতিহাসে শুধু দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে, কিন্তু প্রাপ্তির খাতায় রয়ে গেছে শূন্য। দুঃখজনক- এমন ত্যাগ ও অবদানের পরও রংপুরের উন্নয়ন যেন বাজেট বৈষম্যের চোরাবালিতে হারিয়ে যায়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে সব সিটি করপোরেশনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৫ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। ওই বছর রংপুর মহানগর পেয়েছিল মাত্র ৪৩ কোটির কিছু উপরে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও মোট বরাদ্দ প্রায় একই! সে বছর পেয়েছিল ২০ কোটি টাকা। গত ২৪-২৫ এর বাজেটে ১২টি সিটি করপোরেশনের টাকার পরিমাণ ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থাকলেও রংপুরের জন্য ছিল না ১ টাকাও।
এ ছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঢাকা যেখানে পায় ৭০০০+ প্রকল্পের বাজেট, রংপুর সেখানে ১১৯৭ এবং সেটিও দেশের সর্বনি¤œ।
একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২-১৩ থেকে ১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায় ঢাকা পায় ৩৮.৫৪%, চট্টগ্রাম ২৭.৫৪ আর সেখানে রংপুর পায় মাত্র ৩.১৩%, যা সব বিভাগের মধ্যে সর্বনি¤œ।
অতএব, ভাববার অবকাশ রাখে না যে- বিভাগ হিসেবে বাজেট বা উন্নয়নের খাতায় রংপুরের অবস্থান কোথায় ছিল এই ৫৪ বছরে।
অথচ এর ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর কোনো ভালো প্রভাব পড়ছে না বরং দেশের কেন্দ্রীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একটি দেহের সুস্থতা এবং উন্নতি যেমন সমস্ত অঙ্গের সুস্থতা ও উন্নয়ের ওপর নির্ভরশীল, একটি দেশও ঠিক তেমনি। নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের উন্নয়ন দিয়ে কিংবা কোনো অঞ্চলকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় অগ্রগতির ব্যাপক উন্নয়ন আশা করা নিছক বোকামি বৈ নয়।
রংপুরও হোক দেশের অগ্রযাত্রার সারথী
রংপুরকে টেকসই উন্নয়নের পথে আনতে ও দেশের উন্নয়নের ধারায় অবদান রাখতে যা কিছু কাজ অবিলম্বে করা দরকার-
রংপুরে কোনো শিল্পাঞ্চল নেই, নেই কোনো গার্মেন্টস ফ্যক্টরি; উদ্যোগ নেওয়া হয় না, হতে দেওয়া হয় না। পোশাকশিল্প, কৃষি-প্রসেসিং, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা হলে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে, ঢাকাকেন্দ্রিক নির্ভরশীলতা কমে আসবে, ঢাকায় চাপ কমবে, দেশের উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।
রংপুর বিভাগের প্রতিটি জেলারই নিজস্ব কোনো না কোনো হালকা শিল্প খাত রয়েছে। কিন্তু সরকারের সহযোগিতা এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সেগুলোর যথেষ্ট উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এগুলোর পর্যাপ্ত উন্নয়ন সাধন করতে পারলে তা যেমন দেশের বিপুল পরিমাণ বেকারের কর্মসংস্থান করতে পারত তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারত।
পাট, আলু, ভুট্টা, চাল- এলাকার প্রধান ফসলগুলো থেকে ভ্যালু-অ্যাডেড প্রোডাক্ট তৈরি করার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।
একমাত্র ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে উন্নয়ন হলেও (হচ্ছে) মধ্যবিত্তের সাশ্রয়ী বাহন রেল যোগাযোগ এখনো ধীর ও সীমিত। বিভাগীয় শহর রংপুরের সঙ্গে স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও ব্রডগেজ/ডাবল লাইন করা সম্ভব হয়নি। যা সেটিও আবার করা ওই ব্রিটিশ আমলেই, তবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের প্রাপ্তি কোথায়? ফলে ৮ জেলার মধ্যে রেল যোগাযোগ থাকলেও তার সুবিধা এ অঞ্চলের মনুষ পাচ্ছে না, অথচ এই বিভাগের আন্তঃযোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হওয়ার কথা ছিল এই রেল।
সরাসরি বিমান যোগাযোগ নেই, বিভাগীয় শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে বিভাগের প্রধান বিমানবন্দর, সেটিও আন্তর্জাতিক মানের নয়। সেখান থেকে বিভাগীয় শহরের রেললাইন থাকলেও গেজ সমস্যার কারণে রেলযোগাযোগ নেই; এহেন দুঃখজনক ব্যাপার বলতেও লজ্জা লাগে।
এদিকে গাইবান্ধা থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত একটি টানেল বা রেলসেতু এ অঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি। এতে পূর্ব ও দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম, অর্থনৈতিক খাতে আনবে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন। এতে রংপুর বিভাগের মানুষজন সহজেই ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা এবং সিলেটে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যাওয়া-আসা করতে পারবে- মালামাল পরিবহন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু সরকারের সুপরিকল্পনার অভাবে তা আজ আলোর মুখ দেখছে না।
অপরদিকে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথও একই ধারায় আটকে রয়েছে প্রায় ১ যুগ ধরে। এটি হয়ে গেলে এ অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ ও মালামাল কম ভাড়ায় রেলে করে ঢাকা ও দক্ষিণাঞ্চলে আসা-যাওয়া করতে পারবে যা মোটর মালিক সমিতি তা কখনোই চায় না। এর ফলে এবং সরকারের অবহেলার কারণে এটিও দীর্ঘদিন ধরে আটকে রয়েছে- ৭০ কিলোর পথ নাটোর দিয়ে ১৮০+ কিলো ঘুরে যেতে হয়। আশার খবর, পুনরায় কার্যক্রম শুরু হয়েছে কিন্তু দেখার বিষয় এটি আবারও কোনো রহস্যের বেড়াজালে আটকে যায় কিনা- আমরা আশা করছি সেটি যেন না হয়, সরকার যেন এ বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করে। এ ছাড়াও আন্তঃজেলা সড়কও উন্নত নয়।
রংপুরের প্রাণকেন্দ্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু দুঃখের বিষয় সেখানে নেই কোনো গবেষণা ইনস্টিটিউট অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্যই থাকে গবেষণা, শুধু তাই নয় সেখানে পড়ানো বিষয়ের সংখ্যাও একেবারে অপ্রতুল (২২)- নেই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেমন- ফার্মেসি, নগর উন্নয়ন, আইন, দর্শন, কৃষি, উদ্ভব ও প্রাণী বিজ্ঞান প্রভৃতি, যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৃষি গবেষণায় জোর দেওয়া উচিত। এ ছাড়াও বিভাগের অন্য জেলার যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেগুলোরও একই হাল।
আধুনিক ক্যানসার হাসপাতাল, হার্ট ইনস্টিটিউট, এবং মাতৃ-শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। বিভাগীয় শহরের একমাত্র সরকারি হাসপাতালটিরও জনবল ও যন্ত্রপাতি ঘাটতি, অনিয়ম বছরের পর বছর অমীমাংসিত। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে লালমনিরহাটের নানা ঐতিহাসিক স্থান পর্যটনের জন্য উন্নত করলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।
সাঁওতাল, গারোসহ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করতে পারলে তা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। রংপুর বাংলাদেশের একমাত্র বিভাগ যার ৮টি জেলা শহরের সঙ্গেই রেল সংযোগ বর্তমান। দেশের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত রংপুরের- মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্ত। তাদের যাতায়াতের প্রথম পছন্দ সাশ্রয়ী মাধ্যম রেল। অথচ সদিচ্ছা ও পরিকল্পনার অভাবে সরকার জনগণের কাজে ও অর্থনীতির উন্নয়নে সম্ভাবনাময় এই খাতটিকে কাজে লাগাতে পারছে না অথবা কাজে লাগাচ্ছে না- অন্যান্য ব্যক্তিক পরিবহন ও বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনায় রেখে। অন্যথায় এতদিনে রেল যোগাযোগে রংপুর বিভাগ অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হওয়া সম্ভব ছিল।
রংপুরে গার্মেন্টস ফ্যক্টরি এবং পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল স্থাপনসহ রংপুর জেলাকে শিল্প-কারখানা-উন্নয়নের কেন্দ্র করে, বাকি ৭ জেলার সঙ্গে রংপুরকে রেল যোগাযোগের কেন্দ্র করলে এই অঞ্চল অচিরেই বাংলাদেশের উন্নয়নে অভূতপূর্ব অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে আমি আশাবাদী এবং এটি যৌক্তিক। রংপুরের মানুষ শুধু ভোটের মৌসুমে নয়, প্রতিটি বাজেটে, প্রতিটি পরিকল্পনায় বর্তমান থাকার অধিকার রাখে।
সময় এসেছে রেল সংযোগের সদ্ব্যবহার এবং কৃষি সম্পদ ও মানবসম্পদ কাজে লাগিয়ে রংপুরকে দেশের উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বানানোর। নইলে ইতিহাস হয়তো আবারও লিখবে, রংপুরের গল্প শুধুই ত্যাগের, প্রাপ্তির খাতা শূন্যের।
মোকছেদুল মমিন, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর